মুগদার চিকিৎসকদের ‘ব্যবসায়িক স্বার্থে ষড়যন্ত্রমূলক’ বদলি!
২৬ মে ২০২০ ১৬:৪৭
ঢাকা: সম্প্রতি মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিন চিকিৎসককে বদলি ও একজনকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ওএসডি করা হয়েছে। সরকারি যেকোনো হাসপাতালের চিকিৎসকদের বদলি একটি স্বাভাবিক বিষয় বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) চিকিৎসায় রাজধানীর অন্যতম মুগদা জেনারেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের বদলির পেছনে কাজ করেছে ব্যবসায়িক স্বার্থ। সেজন্য তাদের ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বদলি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ একাধিক চিকিৎসকের।
খোদ রাজধানীতেই যখন চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন তখন মুগদা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালের চিকিৎসকদের এমন বদলি এবং ওএসডি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা আলোচনা ডালপালা মেলছে। মূলত হোটেল ব্যবস্থাপনাকে ঘিরেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
কোভিড-১৯ চিকিৎসা দেওয়া হাসপাতালগুলোর চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দায়িত্ব পালন শেষে কোয়ারেনটাইনে থাকার জন্য আলাদাভাবে হোটেল নির্ধারণ করা হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে। তবে মুগদা হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য হোটেল নির্ধারণ করতে বলা হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই। আর এজন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি কমিটিও গঠন করে। কমিটির দুজন সদস্য বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করে প্রথমদিকে কোনো হাসপাতাল ঠিক করতে না পারলেও পরবর্তীতে বিজয়নগরের হোটেল ৭১, ফার্স হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসহ আরও দুটি হোটেল ঠিক করেন। একই সঙ্গে নার্সদের থাকার জন্য হোটেল এশিয়া, সার্কেল ইন, স্টার ও রয়েল প্যালেসকে নির্ধারণ করা হয়। এছাড়াও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকার জন্য হোটেল মেলোডি, হোটেল শালিমার, চিটাগাং হোটেল ও হোটেল ডিলাক্স ঠিক করা হয়।
আরও পড়ুন: মুগদা মেডিকেলের অধ্যক্ষসহ ৩ জনকে বদলি, চিকিৎসকদের মাঝে ক্ষোভ
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষে হোটেল ৭১’র সঙ্গে একটি চুক্তি করা হয়। ৫০টি রুম বরাদ্দের বিষয়ে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয় । কিন্তু কোভিড-১৯ চিকিৎসা দেওয়ায় চিকিৎসকদের সঙ্গে হোটেলের কর্মচারীরা ভালো আচরণ করতো না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি কোনো রুম সার্ভিসের ব্যবস্থাও ছিল না। সেইসঙ্গে খাদ্য সরবরাহের সময়ও নানা ধরণের অবহেলার শিকার হতে হয়েছিল চিকিৎসকদের। ২০ এপ্রিল থেকে সেই হোটেলে থাকলেও পরবর্তী সময়ে চিকিৎসকরা সেখানে থাকতে অনীহা প্রকাশ করেন।
হোটেল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত এক চিকিৎসক বলেন, ‘প্রথমে আসলে কতজন চিকিৎসক থাকতে পারেন সেটা বুঝে ওঠা যায়নি। তাই হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ৫০টি রুম বরাদ্দের বিষয়ে চুক্তি হয়। পরবর্তী সময়ে যখন চিকিৎসকরা সেখানে থাকতে চাচ্ছিলেন না; নানা অবহেলার কারণে তখন আমরা হোটেল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করি রুম সংখ্যা কমিয়ে আনার বিষয়ে। সেই অনুরোধ তারা রাখেননি। সেইসঙ্গে হোটেলে সার্ভিসের মানও বাড়াননি। এসব বিষয়ে আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতরেও জানাই। পরে আমরা আরও কম খরচে আরেকটি হোটেল পেয়ে যাই গুলশানে। হোটেল ওরিয়েন্টালে আমরা যখন থাকতে যাই তখন আসলে এটা হোটেল ৭১ কর্তৃপক্ষ ভালোভাবে নেয়নি। আর এর পরেই এই বদলি এবং ওএসডির সিদ্ধান্তগুলো এলো।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন চিকিৎসক বলেন, ‘সার্ভিসের মান ভালো না হওয়ার নার্সদের জন্য ঠিক করা হোটেলগুলোতেও দুয়েকবার পরিবর্তন এসেছে। আমাদের হোটেল পরিবর্তনের পরে হোটেল ৭১ কর্তৃপক্ষও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমরা তাদের সার্ভিসের মান বাড়ানোর অনুরোধ জানাই। আর এরপরেই দেখি এমন বদলি এবং ওএসডির সিদ্ধান্ত।’
একাধিক চিকিৎসক অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা তো হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়েই সারাদিন কাজ করতে থাকি। এর মধ্যে হোটেল ব্যবস্থাপনার দিকে আলাদাভাবে নজর দেওয়ার সময় কারও নেই। তাই হোটেল ব্যবস্থাপনার জন্য একটা আলাদা কমিটি করা হয়। সেই কমিটির সদস্য হিসেবে যারা ছিলেন তাদেরকেই বদলি এবং ওএসডি করা হয়েছে।’
তারা আরও অভিযোগ করে বলেন, লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- মন্ত্রণালয়ের আদেশগুলো একসঙ্গে আসেনি। প্রথমদিকে একজন চিকিৎসককে ওএসডি করার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। আর এরপরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ও অধ্যক্ষকে বদলি করা হয়। এরপরে দুই ধাপে আরও দুজন চিকিৎসককে বদলি করা হয়। এটা তো ভালো কিছু ইঙ্গিত করে না।
এখানে রাজনীতিসহ আরও নানা রকমের ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলে অভিযোগ করেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালের আরেকজন চিকিৎসক অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের একজন চিকিৎসককে ওএসডি করা হয়েছে। বদলি একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু কোনো সুর্নিদিষ্ট অভিযোগ ছাড়া আসলে ওএসডি স্বাভাবিক কোনো বিষয় না। যদি তিনি কোনো দুর্নীতি করে থাকেন তবে সেটার তদন্ত হয়নি কেনো? কোনো তদন্ত ছাড়াই কেনো ওএসডি করা হচ্ছে? যদি কোনো অপরাধ কেউ করে থাকে তবে তার তদন্ত করেই ওএসডি বা বদলি হওয়া দরকার।’
আরও পড়ুন: হোটেল ৭১ এ টয়লেট পরিষ্কার করতে হতো করোনায় সেবা দেওয়া চিকিৎসকদের
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সরকারি চাকরি করি। সরকারি আদেশে বদলি একটি স্বাভাবিক বিষয় যা আমরা মেনে নেব অবশ্যই। কিন্তু সেটা স্বাভাবিকভাবে হলেই মানা যায়। বিশেষ পরিস্থিতিতে যখন আমরা চিকিৎসাসেবা দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত তখন হোটেল ব্যবস্থাপনা নিয়ে এভাবে বদলি করা আসলে অপমানজনক। এর পেছনে নিশ্চিতভাবে একটা গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকায় এই সিদ্ধান্তকে ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হচ্ছে।’
বদলি হওয়া একজন চিকিৎসক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি সারাদিন হাসপাতালে কীভাবে চিকিৎসাসেবা উন্নত করা যায় সেটা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। আমাদের এই হাসপাতালেই কিন্তু রোগীদের সুস্থ হওয়ার মাত্রাও বেশি। ক্রিটিক্যাল রোগীও কিন্তু এখান থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেছেন। একজন চিকিৎসকের কাজ তো আসলে সেবা দেওয়া; আমরা সেটাই করছিলাম। যেহেতু সরকারি চাকরি করি তাই আসলে বদলির বিষয়টাও খুবই স্বাভাবিকভাবে দেখি। কিন্তু সেটা আসলে এমন অভিযোগ ওঠার পরে যদি হয় তবে তা অপমানজনক। আমাদের বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে তবে তার তদন্ত হোক। দোষী সাব্যস্ত হলে আমরা সমগ্র জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে সরে যাব। কিন্তু তা না করে এভাবে ব্যবসায়িক স্বার্থে আমাদের পেশার ওপর অভিযোগ দেওয়া অপমানজনক।’
হোটেলে সেবা না পাওয়া বিষয়ে সারাবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় হোটেল ৭১ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। ২৪ মে দুপুর ১ টা ৪৪ মিনিটের দিকে হোটেলের রিসিপশনে যোগাযোগ করলে মো. শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘আমাদের ম্যানেজারকে আপনার নম্বর দিয়ে রাখছি। উনি যোগাযোগ করবেন।’ এ সময় তিনি প্রতিবেদকের নাম, পদবী ও মোবাইল নম্বর নিয়ে রাখেন।
দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরে কেউ যোগাযোগ না করলে বিকেল ৪টা ১৬ মিনিটে আবার যোগাযোগ করা হয় হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। এ সময় মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘যেহেতু এখন ঈদ তাই এখন কাউকে পাওয়া যাবে না। ঈদের পরেই উনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। চিকিৎসকদের অভিযোগ বিষয়ে কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। এটা আসলে ম্যানেজমেন্ট থেকেই বলতে পারবে।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আসাদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি মোবাইল ফোনের কল ধরেননি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে বদলি একটি স্বাভাবিক বিষয়। প্রশাসনিক কারণেই তাদের বদলি করা হয়েছে। খুব দ্রুতই এ বিষয়ে বিস্তারিত সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে।’ হোটেল ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে দেখা হয়ে থাকে। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।’
উল্লেখ্য, শনিবার (২৩ মে) মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কলেজের অধ্যক্ষ ও প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ গোলাম নবী তুহিনকে বর্তমান দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজে এবং মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড-১৯ চিকিৎসা কমিটির সভাপতি ও নাক, কান গলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটুকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়াও কোভিড-১৯ চিকিৎসার ফোকাল পারসন সার্জারির সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাহবুবুর রহমান কচিকে জামালপুরে বদলি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আর চক্ষু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোত্তালিব হোসেনকে ওএসডি করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
ওএসডি চিকিৎসক বদলি ব্যবসায়িক স্বার্থ মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ষড়যন্ত্রমূলক