রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর আধুনিকায়নে উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত
২ জুলাই ২০২০ ২২:৫৮
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) পরিচালিত রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একে আরও সক্ষম করে গড়ে তুলতে উৎপাদন বন্ধ করে শ্রমিকদের এককালীন পাওনা পরিশোধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এজন্য বিজেএমসি’র ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে শ্রমিকদের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার পাওনা পরিশোধ করা হবে সরকারের পক্ষ থেকে।
বৃহস্পতিবার (২ জুলাই) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো নিয়ে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমেদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সচিব লোকমান হোসেন মিয়া বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন- বাজেটের টাকা ছাড় হলেই পাটকল শ্রমিকরা বকেয়া বুঝে পাবে: পাটমন্ত্রী
বৈঠক শেষে বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে (পিএমও) সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, ‘সরকারি খাতের পাটকলগুলোর সংস্কার ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে শ্রমিকদের সব পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
মুখ্য সচিব বলেন, বর্তমানে দেশে যে পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদিত হয়, তার শতকরা ৯৫ শতাংশই বেসরকারি পাটকলে উৎপাদিত হয়। সরকারি খাতটি অত্যন্ত স্কুইজড (সংকুচিত) হয়ে গেছে, যা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছিল না। এগুলোকে আবার প্রতিযোগিতায় কিভাবে আনা যায় এবং কিভাবে শক্তিশালী করা যায়, সে বিবেচনায় এখন পাটকলগুলো বন্ধ করার ঘোষণা করা হয়েছে।
এসব পাটকল বন্ধ থাকলে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, চালু থাকলে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ক্ষতি হয়— এ বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, ‘কাজেই এসব পাটকলের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক ভাইদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তার জন্য সরকার তাদের ২০১৫ সালের জাতীয় মজুরি কাঠামো অনুযায়ী সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
ড. কায়কাউস বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশনাও দিয়েছেন— বন্ধ পাটকলগুলো কিভাবে চালু করা যায় এবং সেগুলো যেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে, এ সংক্রান্ত একটি কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। সেটি দ্রুত তাকে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
মুখ্য সচিব পাটকলগুলোর ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো গত ৪৮ বছরের মধ্যে শুধু চার বছর লাভের মুখ দেখেছে এবং ৪৪ বছর ধরে অব্যাহতভাবে মোট ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। লোকসান হলে কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জন্য সরকারের অর্থের ওপর নির্ভর করতে হতো বলে প্রতি মাসেই শ্রমিক-কর্মচারীদের এ সংক্রান্ত সমস্যা চলছিল।
মুখ্য সচিব বলেন, পাটকল শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের লক্ষ্যে আগামী তিন দিনের মধ্যে তাদের তালিকা প্রস্তুত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৫ সালের সর্বশেষ মজুরি কাঠামো অনুযায়ী পাটকলগুলোর ২৫ হাজার শ্রমিককে তাদের অবসরকালীন সুবিধাসহ পাওনা পরিশোধ বাবদ সরকারের ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে।
মুখ্য সচিব বলেন, ‘পাটখাতের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নজর রয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীর দর্শন হচ্ছে পাটকল শ্রমিকদের বাঁচানো।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী এর আগে পাটের জন্মরহস্য উন্মোচনের জন্য গবেষণা খাতে অর্থায়ন করেছিলেন এবং পাটের বহুমুখী ব্যবহারের ওপর বিশেষ নজর দেন বলেও উল্লেখ করেন ড. কায়কাউস।
শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের ধরন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যেসব শ্রমিক অনধিক দুই লাখ টাকা প্রাপ্য হবেন, তাদের পুরো টাকা এককালীন নগদ পরিশোধ করা হবে। দুই লক্ষ টাকার বেশি পাওনাদার শ্রমিকরা গড়ে ১৩ দশমিক ৮৬ লাখ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫৪ লাখ টাকা পাবেন।
মুখ্য সচিব বলেন, পাওনা টাকার মধ্যে ৫০ শতাংশ এককালীন নগদ এবং অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ শ্রমিকদের ভবিষ্যত জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয় পত্র আকারে পরিশোধ করা হবে।
সঞ্চয় পত্রের মাধ্যমে প্রাপ্ত আর্থিক সুবিধার বর্ণনা দিয়ে ড. কায়কাউস বলেন, ১১ শতাংশ সুদে প্রত্যেক শ্রমিক প্রতি তিন মাসে সর্বনিম্ন ১৯ হাজার ৩২০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৭৪ হাজার ৫২০ টাকা পর্যন্ত পাবেন। এছাড়া এ পর্যন্ত অবসরে যাওয়া ৮ হাজার ৯৫৬ জন পাটকল শ্রমিকের অবসর ভাতা পরিশোধ করতে সরকারের ১ হাজার ২০ কোটি টাকা খরচ হবে বলে ও জানান তিনি।
মুখ্য সচিব বলেন, পাটকল শ্রমিকদের পাওনা টাকা সরাসরি তাদের ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হবে এবং কোনো পাটকল অথবা অন্য কোনো মধ্যস্বত্বভোগী এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকবে না।
ব্রিফিংয়ে উপস্থিত বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব লোকমান হোসেন মিয়া জানান, অবসরভোগীদের টাকা আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই নিজ নিজ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যাবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে মুখ্য সচিব বলেন, ‘এখানে কাউকে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে না এবং পরবর্তী সময়ে এ কারখানাগুলো পুনরায় চালু হলে নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।’
এর আগে, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীকও জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পাটকল শ্রমিকদের সব ন্যায্য পাওনা ও বকেয়া বাজেট পাসের পর অর্থছাড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রমিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যাবে। ২৬ হাজার পাটকল শ্রমিকের যার যা পাওনা রয়েছে, তার পুরোটাই তারা পেয়ে যাবেন।
শ্রমিকদের আশ্বস্ত করে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, শ্রমিকদের আর চিন্তার কিছু নেই। আমি নিজেও শিল্পপতি। আমারও শ্রমিক আছে। আমি যেমন আমার শ্রমিকদের দেখি, পাটকল শ্রমিকদেরও আমি একইভাবে দেখব। তাদের সব দাবি-দাওয়ার সমাধান আমি করব। আমি বিশ্বাস করি, শ্রমিকদের ভয়ের কিছু নেই। বাসস।
আরও পড়ুন-
মন্ত্রীকে পাটকল শ্রমিকদের ধন্যবাদ, মন্ত্রীর প্রধানমন্ত্রীকে
‘১৫ দিনের মধ্যে পাটকল শ্রমিকদের মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন’
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর ঘোষণায় পাটকল শ্রমিকদের অনশন প্রত্যাহার
পাটকল শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধে ১১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ
পাটকল শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধে বিজেএমসিকে ১শ কোটি টাকা বরাদ্দ
গোলাম দস্তগীর গাজী পাটকল পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত পাটকল শ্রমিক পাটকলের আধুনিকায়ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক বিজেএমসি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল