Saturday 12 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘ওয়েব সিরিজ নীতিমালা নির্মাতা-অভিনেতাদের কাছ থেকে আসতে হবে’


৬ জুলাই ২০২০ ২৩:৫৮

ঢাকা: ওয়েব সিরিজের নীতিমালা তৈরির খসড়াটি নিমার্তা ও অভিনেতাদের কাছ থেকেই প্রথমে আসতে হবে। সরকার কেবল তাতে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করতে পারবে। নীতিমালা তৈরির জন্য একটি ‘বিনোদন কমিশন’ও করা যেতে পারে। আর নীতিমালায় শুধু শ্লীলতা-অশ্লীলতার বিষয়টিই নয়, বরং বিদেশি প্ল্যাটফর্মগুলো যে আয় করবে, তার একটি অংশ বাংলাদেশে আবার পুনঃবিনিয়োগ করতে হবে— এমন শর্তও উল্লেখ থাকতে হবে। বর্তমানে ওয়েব সিরিজ নিয়ে অভিনেত্রীরা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। অভিনয়ের কারণে তারা সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছে। যারা সাইবার বুলিংয়ে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (২৯ জুন) বিকেলে সারাবাংলা ডটনেটের নিয়মিত আয়োজন সারাবাংলা ফোকাস অনুষ্ঠানে ‘ওয়েব সিরিজে শ্লীলতা ও অশ্লীলতা বিতর্ক ২’ শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। সারাবাংলা ডটনেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এমএকে জিলানী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। এতে অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম ও অভিনয় শিল্পী আজাদ আবুল কালাম। অনুষ্ঠানটি এক যোগে সারাবাংলার ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল এবং বেসরকারি টেলিভিশন জিটিভি থেকে সরাসরি প্রচারিত হয়।

বিজ্ঞাপন

চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম বলেন, আমাদের এই উপমহাদেশে বঙ্কিমচন্দ্র কাগজে-প্রথম অশ্লীল শব্দটি প্রথম প্রচলন করেছিলেন। আমাদের যাত্রাপালায় যে আদিরস থাকে, তাকে অশ্লীল বলেছিলেন তিনি। অথচ যাত্রাপালা একটি লোকজ ফর্ম এবং বিশ্বের সব লোকজ ফর্মেই আদিরস থাকে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বঙ্কিমচন্দ্র সেটাকে অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেন। আমার ধারণা, কলোনিয়ান হ্যাংওভার থেকে তিনি ওই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। এখন আজকের এই ২০২০ সালে শ্লীলতা-অশ্লীলতা কিভাবে নির্ধারিত হবে, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ওয়েস্টে যেভাবে শ্লীলতা-অশ্লীলতা নির্ধারণ করে, আমরা নিশ্চয় আমরা সেভাবে নির্ধারণ করব না। নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করেই আমরা তা নির্ধারণ করব। তিনটি ওয়েব নিয়ে যে বিতর্ক এত লম্বা সময় ধরে আমরা করছি, এটা আর ভালো লাগছে না। আমাদের বিনোদন শিল্পে শিক্ষা ব্যবস্থায় যেমন ড. কুদরত ই খুদা কমিশন তৈরি হয়ে উনাদের সুপারিশ দিয়েছে, তেমনি বিনোদন শিল্পের জন্যও একটি কমিশন করে, এই বৈশ্বিক বাজারের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করে দিতে পারে। এটি খুব জরুরি।

আরও পড়ুন- রুচির প্রশ্নে দায় কি শুধু দেশি প্ল্যাটফর্মের?

তিনি বলেন, নীতিমালার ক্ষেত্রে কেবল অশ্লীলতা বিষয়টি রাখলে চলবে না। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো কিভাবে চলবে, তার নীতিমালা লাগবে। যেমন— নেটফ্লিক্স আগে বছরে ২০০ কোটি টাকা নিয়ে যেত, এখন করোনার কারণে একশ কোটি টাকা বেশি নিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপে যখন নেটফ্লিক্স দেখায়, ওরা সেখান থেকে যে রেভিনিউ নিয়ে যায়, তার একটি অংশ স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ করতে হয়। স্থানীয়দের কমিশনিং করে সিরিজ বানাতে হয়। একইভাবে আমাদের নীতিমালাতেও থাকতে হবে— নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজন প্রাইম যে বিজনেস করবে, তার রেভিনিউয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ, যেমন— ২০ বা ৩০ শতাংশ আমাদের দেশের অভিনেতাদের নিয়ে সিরিজ বানাতে রি-ইনভেস্ট করতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলা ওয়েব কনটেন্টের অনেক বড় বাজার আছে। এক বিতর্কের মধ্যে আমরা পড়ে না থেকে সামনের দিকে দেখতে হবে। পুরো বাংলার কৃষ্টি-কালচার এই ওয়েব সিরিজের মাধ্যমে পুরো বিশ্বের সামনে আমরা তুলে ধরব— এটাই আমার প্রত্যাশা।

অভিনয় শিল্পী আজাদ আবুল কালাম বলেন, ‘বৈঠক করে যে নীতিমালা তৈরি করা হয়, তা কিন্তু বাস্তবায়ন করা যায় না। কুদরত ই খুদা কমিশনের যে সুপারিশ ছিল, সেটা কিন্তু কোনোদিন বাস্তবায়ন হয়নি। কোনো সরকার এটাকে নেয়নি। এই শিক্ষা ব্যবস্থা যদি চালু হতো, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার চেহারা কিন্তু পাল্টে যেত। আবার নীতিমালা তৈরি করবে কে? আমার ওপর যদি চাপিয়ে দিতে চান, সেই নীতিমালা তো কখনও কার্যকর হবে না। তাতে বরং নির্মাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ লোকে অনলাইনে তো সবকিছু দেখছে, আপনি তো সবকিছু বন্ধ করতে পারবেন না। তখন বাংলাদেশের কনটেন্ট না দেখে বিদেশি কনটেন্ট দেখবে। তার মানে এই না যে আমরা যা ইচ্ছা তাই কনটেন্ট বানাব। নিজেদের রুচির বিষয় যেমন আছে, তেমনি শিল্পেরও মানদণ্ড আছে। নীতিমালা তৈরি করার ক্ষেত্র অবশ্যই যে ড্রাফট হবে, সেটা প্রথম আসতে হবে এই আমাদের ভেতর থেকে। সেটার সঙ্গে সরকার চাইলে কিছু যোগ-বিয়োগ করতে পারে। কারণ ভুক্তভোগী তো আমরা।

থিয়েটার ও টেলিভিশনের এই অভিনেতা বলেন, ওয়েব সিরিজ ড্রয়িং রুমে বসে দেখার বিষয় না। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে দেখবেন ঈদের নাটক, ঈদের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখলে কেমন লাগে! এটা তো প্ল্যাটফর্মটাই ভিন্ন। আপনাকে টাকা দিয়ে সাবস্ক্রাইব করে দেখতে হবে। এটা কোন কোন বয়সের মানুষ দেখতে পারবে, সেটাও উল্লেখ থাকে। এখন সবাই এটা দেখতে পেরেছে, কারণ এটা পাইরেটেড হয়ে ইউটিউবে চলে এসেছে। কিন্তু এখন সবখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তারপরও এখন যেটি দেখতে পাবেন, সেটি হলো বিশেষ বিশেষ কিছু অংশ কেটে নিয়ে বানানো একটি ক্লিপ। এটা কিন্তু সাইবার বুলিং। যারা জনে জনে এটা পাঠিয়ে দেখানোর দায়িত্ব নিজেদের ওপর নিয়ে নিয়েছেন, তারা একটি জঘন্য অপরাধ করছেন। এ ধরনের সাইবার বুলিংয়ে যারা জড়িত, তাদের সবার ডিজিটাল আইনে বিচার হওয়া উচিত।

বর্তমান পরিস্থিতিতে অভিনয় শিল্পীদের হেয় হতে হচ্ছে উল্লেখ করে আজাদ আবুল কালাম বলেন, আরেকটি বিষয় হলো— যারা জনে জনে এই ক্লিপ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, তারা একটা বিষয় ভাবেন না যে যারা পেছনে থাকে, তারা কিন্তু টার্গেটেড হয় না। যেমন— বুমেরাং সিরিজটি কে বানিয়েছে, লোকে তাকে চিনবে না। যাকে দেখা যায় অনস্ক্রিনে, তারা টার্গেট হয়। তাদেরকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে মেয়েদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করা। যে কাজগুলো তারা করেছে— ছোট ছোট অংশ কেটে কেটে জোড়া দিয়ে সেগুলো ছড়িয়েছে। তারা জানে না যে এরকম ঘটনা বিশেষ করে যারা অভিনেত্রী, তাদের জীবনকে কী রকম দুর্বিষহ একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে পুরো দায় মেয়েদেরই বহন করতে হচ্ছে। এটা কতগুলো মানুষকে সামাজিকভাবে অনিরাপদ করে দেওয়ার একটা প্রসেস।

অভিনয় শিল্পীদের ভূমিকা উল্লেখ করে অভিনয় শিল্পী আজাদ বলেন, অভিনয় শিল্পীরা কিন্তু নাটকের একটি অংশ মাত্র। তার ভূমিকা কেবলই পরিচালকের নির্দেশনা অনুসরণ করা। আমি যখন অভিনয় করতে যাই, তখন আমার সত্ত্বাটিকে বাসায় রেখে যাই। যে পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে যাই, তাকে কনভিন্সিং হলে তার সব কথা শোনার চেষ্টা করি। সে যেভাবে বলে, সে যেভাবে হাঁটতে বলে, সে যেভাবে কাপড় পরতে বলে— তাই করি। বেশিরভাগ অভিনেতার ক্ষেত্রেই এমনটিই হয়। আবার অনেক সময় আমি অনেক কাজ করি না। অভিনেতা হিসেবে আমি অনেক চুজি। কিন্তু যে কাজটি আমি করার জন্য রাজি হই, সেই কাজটিতে আমি নিজেকের পরিচালকের ওপর ছেড়ে দিই। যে তিনটি নাটকের কথা বলা হচ্ছে, তার একটিতে আমি অভিনয় করেছি। সেটিও একটি চরিত্র, যেটি একজনের ছায়া। ছায়া চরিত্র। বুমেরাংয়ের প্রথম দৃশ্যেই আমার উপস্থিতি আছে। সেটা হচ্ছে ছায়া চরিত্র। ৩০ সেকেন্ডের একটা উপস্থিতি ওখানে আছে।

তিনি আরও বলেন, বুমেরাংয়ে তো আমি অভিনয় করেইছি। বাকি দুইটি সিরিজও দেখেছি। নতুন প্ল্যাটফর্মে নীতিমালা নির্ধারিত নেই। আর শ্লীল, অশ্লীল, যৌনতা— এগুলো যদি নিয়ে আমার নিজের ধারণা বলতে বলেন, তাহলে বলব অশ্লীলতা নির্ভর করবে কিভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তার ওপরে। আবার যৌনতা তো জীবনের একটি অংশই। নগ্নতাও জীবনের একটি অংশ, আর্টের একটি অংশ। সেখানে এর পরিমাণ নির্ধারণ করাটা হচ্ছে একজন নির্মাতার প্রধান দায়িত্ব। এর উপস্থাপনার কৌশল, পাশাপাশি উপস্থাপনার দক্ষতাও একটি বিষয়। যেহেতু ওয়েব সিরিজগুলো শুরু হয়েছিল একটি বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে, আমি মনে করি এখনো সেই সম্ভাবনা আছে। এই সম্ভাবনার জায়গা থেকে যারা প্রথমবারের মতো কাজ করেছেন, তারা হয়তো কখনো কোনো ক্ষেত্রে শ্লীলতা বা অশ্লীলতার মাত্রা অথবা কতটুকু দেখানো যেতে পারে— এরকম জায়গায় তাদের হয়তো কিছুটা বিচ্যুতি ঘটেছে। অথবা করো কারো রুচিতে লেগেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সোসাইটির দিকে তাকাই, বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু সবকিছু দেখে। হিন্দি সিনেমা থেকে শুরু করে টেলিভিশন, নেটফ্লিক্স— এমন কিছু নেই যে দেখা যায় না। আপনি যত প্রতিবন্ধকতার চেষ্টা করবেন, তত নানা দ্বার খুলবে। পর্ন সাইটগুলো সরকার একসময় বন্ধ করে দিলো; কিন্তু এটা কি বন্ধ হয়েছে আদৌ? মানুষ কি চাইলে দেখতে পারে না?

এর আগে, গ্রামীণফোন (জিপি) ও রবি’র প্ল্যাটফর্ম ও নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ওয়েব সিরিজের নামে সেন্সরবিহীন ‘কুরুচিপূর্ণ’ ভিডিও কনটেন্ট ওয়েবে আপলোড ও প্রচারের বিষয়ে অপারেটর দুইটির কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে, অপারেটর দু’টির প্ল্যাটফর্ম (বায়োস্কোপ ও বিঞ্জ) ও নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ওয়েব সিরিজের নামে সেন্সরবিহীন নগ্ন, অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য, কাহিনী ও সংলাপ সংবলিত ভিডিও কনটেন্ট প্রচার করা হয়েছে।

দেশীয় প্ল্যাটফর্মের উদ্যোক্তা ও নির্মাতারা বলছেন, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, হইচই, হটস্টার, উলু বা জি ফাইভের মতো ওয়েব কনটেন্টের বিদেশি প্ল্যাটফর্মগুলোতেও একই ধরনের কনটেন্ট প্রচারিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কেবল দেশীয় প্ল্যাটফর্মগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে তারা দেখছেন বৈষম্য হিসেবে। এছাড়া তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ব্যাখ্যা দিয়েছে গ্রামীণফোন। সেখানে প্রতিষ্ঠানটি ওয়েব সিরিজের জন্য নির্মাতাদের দায়ী করেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও নীতিমালা তৈরির করার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ে ৫ জুলাই অন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকও হয়েছে। বৈঠক শেষে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বিদেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ওভার দ্য টপ (ওটিটি) প্লাটফর্মে কনটেন্ট ও বিজ্ঞাপন প্রচারসহ সামগ্রিক বিষয়টিকে যুগোপযোগী নিয়ম-নীতি ও করের আওতায় আনা হবে।

আরও পড়ুন-

 

ওয়েব সিরিজ: জিপি ও রবি’র কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়

তথ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা চাওয়া একটু বেশি হয়ে গেছে: ইরেশ যাকের

ওয়েব সিরিজ বিতর্ক: গ্রামীণফোনের দাবি কনটেন্টের দায় নির্মাতাদের

তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সিরিজ বিষয়টি বোঝা এখনো বাকি আছে: শাওন

‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ওটিটি প্লাটফর্ম করের আওতায় আনা হবে’

 

আজাদ আবুল কালাম ওয়েব সিরিজ ওয়েব সিরিজ নীতিমালা ওয়েব সিরিজে অশালীনতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম টপ নিউজ সারাবাংলা ফোকাস

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর