বন্যার শুরুতেই ৫০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি
১৪ জুলাই ২০২০ ১০:৪৮
ঢাকা: দেশে বন্যার শুরুতেই প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অতিবৃষ্টি, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও নদ-নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে এরই মধ্যে দেশের ১৪ জেলায় আউশ ও আমনসহ বিভিন্ন ফসলের ৪৩ হাজার হেক্টর ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনে এই ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৮৬ টন। প্রায় সাড়ে তিন লাখ কৃষকের ৪৯৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকার ফসল কেড়ে নিয়েছে মৌসুমের শুরুর এই বন্যা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, তবে আগাম বন্যায় এখন পর্যন্ত এই ক্ষতি ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তুলনায় প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা কম। কিছুদিন আগে হানা দেওয়া এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ৬৭১ কোটি টাকারও বেশি ফসলের ক্ষতি হয়েছিল।
জানতে চাইলে কৃষি সচিব নাসিরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে, চরাঞ্চলে প্রতিবছরই এরকম ক্ষতি হয়। এবার আউশের যে ক্ষতি হয়েছে, তা ক্ষতি হিসেবেই ধরতে হবে। কিন্তু আমনের ক্ষতিটা ক্ষতি নয়। কারণ ১৭ জুলাই বন্যা শেষ হয়ে যাবে বলে পূর্ভাবাসে বলা হয়েছে। বন্যা শেষ হলে আমরা কমিউনিটি বীজতলা করব। এছাড়া আরও একটি বন্যা হলেও যেন আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যায়, সেজন্য বীজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আমরা তখনো বীজতলা করতে পারব। ফলে তখন এই ক্ষতি কমে আসবে।
প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য নিশ্চিত করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুল মুঈদ সারাবাংলাকে বলেন, আমরা এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পুনর্বাসন কার্যক্রম হাতে নেব। আমনের বীজতলা করব। বন্যার পানি নেমে গেলে কমিউনিটি বীজতলা করা হবে। এছাড়া একবিঘা জমিতে যেন আমন লাগানো যায়, প্রান্তিক কৃষককে সেই পরিমাণ বীজ বা চারা দেওয়া হবে। কারণ যেসব যায়গায় শুকনো জমি নেই, সেখানে রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার দিয়ে ধান লাগাতে ট্রে’তে বীজতলা করা যায়। আমরা কৃষককে ২৫টি ট্রে ও বীজ দেবো, যেন তারা আমন রোপণ করতে পারে। ট্রে’তে করা বীজতলার ১৫ দিনের চারা দিয়েই ধান রোপন করা যায়। এছাড়া প্রত্যেকবারের মতো এবারও ভাসামান বীজতলা তৈরির কাজ চলছে। এভাবেই আমরা এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করব।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের তথ্য অনুযায়ী, অতিবৃষ্টি, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও নদনদীর পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে ২৫ জুন থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত দেশের ১৪ জেলায় আউশ, আমনসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত অন্য ফসলগুলো হলো— আমনের বীজতলা, গ্রীষ্মকালীন সবজি, ভুট্টা, চীনাবাদাম, তিল, মরিচ, পাট, কলাবাগান ও আখ। রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, জামালপুর, নেত্রকোণা, রাজশাহী, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর ও টাঙ্গাইলে এই ক্ষতি হয়েছে।
অধিদফতরের তথ্য বলছে, ওই ১৪ জেলায় এসব ফসলের অর্জিত জমির পরিমাণ ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৪৮৬ হেক্টর। এর মধ্যে আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৭৬ হাজার ২১০ হেক্টর। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৩২ হাজার ১২৪ হেক্টর, আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ ৪৪ হাজার ৬৮ হেক্টর। আংশিক ক্ষতির শতকরা হার ২৭ শতাংশ। তবে আংশিক ক্ষতির ১১ হাজার ৬৯৪ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ ক্ষতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে মোট ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির পরিমাণ ৪৩ হাজার ৮১৮ হেক্টর, যা ফসলি জমির ৮ শতাংশ। এতে উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৮৬ টন। টাকার অঙ্কে এই ক্ষতির পরিমাণ ৪৯৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। আর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৯৫৭ জন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ জেলায় আউশের ২ লাখ ১৯ হাজার ৫৩৯ হেক্টর জমির মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৯ হাজার ৩৫১ হেক্টর। এতে ৬২ হাজার ৭৬১ জন কৃষকের ২৫ হাজার ২৪৮ টন আউশ ধানের ক্ষতি হয়েছে। টাকার অঙ্কে আউশের ক্ষতির পরিমাণ ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। বোনা আমনের ৬৫ হাজার ৯৪৯ হেক্টর জমির মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৯ হাজার ৫০৩ হেক্টর। এতে ২৮ হাজার ৮৯৩ জন কৃষকের ২৫ হাজার ৬৫৮ টন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। টাকার অঙ্কে এই ক্ষতির পরিমাণ ৯২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। আর বোনা বীজতলার ২৫ হাজার ৭৯৭ হেক্টর জমির মধ্যে ৮৬৩ হেক্টর জমির বীজতলা ক্ষতি হয়েছে। এতে ২৭ হাজারের বেশি কৃষকের ৮ কোটি ১৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া গ্রীষ্মকালীন তিলের ক্ষতি হয়েছে ১৯ শতাংশ। ১৬ হাজার ৬৯৯ হেক্টর জমির মধ্যে ৩ হাজার ১৮১ হেক্টর জমির তিলের ক্ষতি হয়েছে। এতে ২১ হাজার ৫২৮ জন কৃষককে ৩ হাজার ১৮১ টন তিলের ক্ষতি গুনতে হয়েছে। টাকার অঙ্কে এই ক্ষতির পরিমাণ ৫৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা। বিভিন্ন ফসলের ক্ষতির হার সর্বনিম্ন ১ থেকে সর্বোচ্চ ১৯ শতাংশ, আর তা গড়ে ৮ শতাংশ।
এর আগে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে দেশের ৪৩ জেলায় আম, লিচু ও ধানসহ ২০টি ফসলের ৬৭১ কোটি ৭০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সাড়ে ৮ লাখ কৃষকের ২ লাখ ৬৫ হাজার ৬৭ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে। পরে আবার জুনের প্রথম দিকে পাহাড়ি ঢল-ঝড়-শিলাবৃষ্টি প্রায় ১০ কোটি টাকার ফসল কেড়ে নেয়। আম্পানের পর জুনের ওই ক্ষতি ছাড়াও এখন নতুন করে ফসলের এই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও আবারও নতুন করে দেশের বেশ কয়েকটি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে, যেখানেও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে।