মেজর সিনহার মৃত্যু: কে বাদী, কে আসামি— উঠে আসবে তদন্তে
৭ আগস্ট ২০২০ ২১:০৩
ঢাকা: দুদিন আগেও ছিলেন মামলায় বাদী। মামলার তদন্তের ভারও ছিল তাদের ওপরই। একই ঘটনায় দুদিন বাদে এখন তারাই আবার হত্যা মামলার আসামি। আত্মসমর্পণ করে যেতে হয়েছে কারাগারে। মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডও মঞ্জুর হয়েছে, তাও সাত দিন করে।
এমন নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী হলো বাংলাদেশ। পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খানের নিহত হওয়ার এই ঘটনা সপ্তাহ পেরিয়ে এখনো ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।
আইনজ্ঞরা বলছেন, যারা মামলার বাদী ছিল, তারাই নতুন মামলার আসামি— ঘটনাচক্রে এমনটি দেখা গেলেও সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমেই বেরিয়ে আসবে সত্য ঘটনা। আর দুইটি মামলার মধ্যে কোনটি চলবে, কোনটি চলবে না— তা আদালত নির্ধারণ করবেন। দুই মামলার তদন্তকারী সংস্থাও বলছে, তদন্তের ওপর নির্ভর করছে মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ।
মামলা ও পাল্টা মামলা
ঈদুল আজহার আগের দিন ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার মেরিন ড্রাইভ সড়ক এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় ওই দিনই মধ্যরাত পেরিয়ে মামলা দায়ের করে পুলিশ। মামলার এজাহারে ৩১ জুলাই রাত ১১টা ১৫ মিনিটে ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয়। আর মামলা দায়েরের সময় উল্লেখ করা হয় ১ আগস্ট প্রথম প্রহর, রাত ১টা ৩৫ মিনিট। টেকনাফ থানায় দায়ের করা মামলাটির বাদী উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত। নিহত সিনহা রাশেদের সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাত এই মামলার আসামি।
মামলার এজাহারে বলা হয়, সিনহা মো. রাশেদ খানের গাড়িকে চেকপোস্টে থামতে বলা হলেও সংকেত অমান্য করে চেকপোস্ট অতিক্রমের চেষ্টা করে। গাড়ির গতিরোধ করে গাড়ি থেকে যাত্রীদের হাত উঠিয়ে নামতে বলা হলেও গাড়ির চালকের আসনে বসা ব্যক্তিটি তর্ক শুরু করে। সেনাবাহিনীর মেজর পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তি কিছুক্ষণ তর্ক করে গাড়ি থেকে নেমে এক পর্যায়ে হঠাৎ তার কোমরের ডান পাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করতে উদ্যত জন। এ পর্যায়ে পুলিশ নিজেদের জানমাল রক্ষায় সরকারি পিস্তল থেকে চার রাউন্ড গুলি করে।
একই ঘটনায় চার দিন পর ৫ আগস্ট আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। মামলায় বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলি ও টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ পুলিশকে আসামি করা হয়। ১ আগস্ট প্রথম প্রহরে দায়ের করা মামলার বাদী নন্দ দুলাল রক্ষিত এই মামলার ৩ নম্বর আসামি।
এই মামলার অভিযোগে বলা হয়, সিনহা মো. রাশেদ খান ২০১৮ সালে ব্যক্তিগত কারণে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। এরপর থেকে তিনি শিল্প ও সংস্কৃতি পরিমণ্ডলে এবং পর্যটন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। ‘জাস্ট গো’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল খোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ওই চ্যানেলের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘরে তথ্যচিত্র ধারণ করছিলেন তিনি।
মামলার অভিযোগে আরও বলা হয়, ঘটনার দিন টেকনাফ বাহারছড়ার পাহাড়ি এলাকায় ওই দিনের শুটিং শেষ করে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে ফিরছিলেন। শামলাপুর চেক পোস্টে পৌঁছালে আসামি পুলিশ সদস্যরা গাড়ির গতিরোধ ধরে। সিফাত হাত উঁচিয়ে বের হয়ে নিজের ও সিনহার পরিচয় দিলে পুলিশ সদস্যরা সিনহাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। এসময় মেজর সিনহা গাড়ি থেকে হাত উঁচিয়ে বের হলেও তাদের গালিগালাজ চলতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত গুলি করলে সিনহা মারা যান।
দুই মামলা দায়েরের পর স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা উঠেছে— যারাই শুরুতে বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন সিফাতের বিরুদ্ধে, তারাই পরে হত্যা মামলার আসামি হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে কোন মামলাটি চলবে? প্রকৃতপক্ষে অপরাধী কারা?
আইনজ্ঞরা যা বলছেন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, একই ঘটনায় একাধিক মামলা দায়ের হলে বিষয়টিকে সাংঘর্ষিক মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে মামলা দু’টি কেন, একই ঘটনায় আরও মামলা হতে পারে। তবে তদন্তে যে ফলাফল বেরিয়ে আসবে, তার ওপর নির্ভর করবে কোন মামলাটি চলবে আর কোনটি চলবে না।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশারও বলেন, একাধিক মামলা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সব মামলা একইসঙ্গে পরিচালিত হবে। যে মামলাটি সঠিক বলে বিজ্ঞ বিচারকের কাছে প্রতীয়মান হবে, পরবর্তী সময়ে সেই মামলাটি তিনি বিচারিক কাজের জন্য চালিয়ে যাওয়ার আদেশ নির্দেশ দেবেন।
এ ঘটনা নিয়ে কথা হয় সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সঙ্গেও। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, একই ঘটনায় একাধিক মামলা হতে বাধা নেই। তবে এখানে যেহেতু এক মামলার বাদী ও তদারককারীরা পরে অন্য মামলার আাসামি হয়েছেন, তাই আদালত সবকিছু শুনে সিদ্ধান্ত নেবেন, কোন মামলাটি তিনি শুনানি করবেন। এক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
মামলা দু’টির তদন্তকারী সংস্থা যা বলছে
পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করা মামলাটি নিয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী উপমহাপরিদর্শক (এআইজি, মিডিয়া) সোহেল রানা সারাবাংলাকে বলেন, পুলিশের দায়ের করা মামলাটির তদন্ত আপাতত বন্ধ রয়েছে। এ ঘটনায় সরকার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত হবে মামলাটি চলবে কি না।
অন্যদিকে, মেজর (অব.) সিনহার বড় বোনের দায়ের করা হত্যা মামলাটি তদন্ত করছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)। জানতে চাইলে এই বাহিনীর গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, সিনহার বোনের দায়ের করা মামলাটি র্যাব-১৫ তদন্ত করছে। অত্যন্ত সংবেদনশীল মামলা এটি। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো হবে। আশা করি তদন্তে সবকিছু পরিষ্কার হবে।
৩ পুলিশ রিমান্ডে, ৪ জনকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, মেজর সিনহা নিহতের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলার তদন্ত বন্ধ রয়েছে। তবে সিনহা হত্যা মামলায় এরই মধ্যে ৯ আসামির মধ্যে ৭ আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন বৃহস্পতিবার (৬ আগস্ট)। এর মধ্যে মামলার প্রথম তিন আসামি পরিদর্শক লিয়াকত, ওসি প্রদীপ ও এসআই নন্দ দুলালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আত্মসমর্পণ করা বাকি চার আসামিকে দুই দিন করে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতিও পেয়েছে র্যাব। মামলার বাকি দুই আসামি এখনো পলাতক। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়েছে আদালত।
এদিকে পুলিশের গুলিতে মেজর সিনহা নিহত হওয়ার ঘটনায় বুধবার সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) নেতৃত্বে সেনা ও পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কক্সবাজার পরিদর্শন করেন। তারা সেখানকার সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে সেনাপ্রধান ও আইজিপি এক যৌথ ব্রিফিংয়ে অংশ নেন।
যৌথ ব্রিফিংয়ে তারা বলেন, পুলিশের গুলিতে মেজর সিনহার মৃত্যুর ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন বলে মনে করছে দুই বাহিনী। এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জয়েন্ট এনকোয়ারি টিম গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির ওপর সেনাবাহিনী ও পুলিশের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তদন্তে এ ঘটনায় জড়িত হিসেবে যাদের নাম বেরিয়ে আসবে, তাদের বিচার হবে জানিয়ে সেনাপ্রধান ও আইজিপি বলেন, ব্যক্তি অপরাধের দায় কোনো প্রতিষ্ঠানের বা বাহিনীর হবে না।
আরও পড়ুন
‘মেজর সিনহা নিহতের ঘটনা দুঃখজনক, জড়িত কেউ ছাড় পাবে না’
মেজর সিনহা নিহতের ঘটনায় টেকনাফের ওসি প্রত্যাহার
মেজর সিনহার মাকে টেলিফোন, বিচারের আশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর
পুলিশের গুলিতে মেজর সিনহার মৃত্যু: আরও ‘শক্তিশালী’ তদন্ত কমিটি
‘সিনহার মৃত্যুকে ইস্যু করে সরকার হঠানোর স্বপ্ন দেখছে কেউ কেউ’
‘সিনহা নিহতের ঘটনায় সেনাবাহিনী-পুলিশের সম্পর্কে চিড় ধরবে না’
সিনহা হত্যা মামলা: ওসি প্রদীপ, ইন্সপেক্টর লিয়াকত কারাগারে
সিনহা নিহতের ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়, ক্রসফায়ার বিকাশের উদাহরণ: টিআইবি
৩ মাসের মধ্যে সিনহা হত্যার বিচার ও দোষীদের ফাঁসি চায় রাওয়া