অ্যান্টিবডির ট্রায়াল শিগগিরই, অ্যান্টিজেন নিয়ে ভিন্ন চিন্তা
৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৩৯
ঢাকা: ঔষধ প্রশাসন প্রণীত ‘কঠিন’ নীতিমালায় আটকে যাওয়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অ্যান্টিবডি কিটের দ্বিতীয় দফা ট্রায়াল শুরু হচ্ছে খুব শিগগিরই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ইন্টারনাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) হবে এক্সটার্নাল ট্রায়াল। আর অ্যান্টিজেন কিটের ব্যাপারে যে শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সে শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশে এটার ট্রায়াল সম্ভব নয়। সে কারণে অ্যান্টিজেন কিট নিয়ে ভিন্ন চিন্তা করছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন কিট উৎপাদন, আমদানি, বিপণন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন গত জুলাইয়ে যে নীতিমালা তৈরি করে, সেটির আলোকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ কিটের মানোন্নয়ন কঠিন হয়ে পড়ে। প্রণীত নীতিমালা অনুসরণ করে কিটের ইন্টারনাল ও এক্সটার্নাল ভ্যালিডেশন শুরু করতে দেড় মাস সময় লেগে যায় তাদের।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে প্রণীত নীতিমালা হাতে পাওয়ার পর সেটি অনুসরণ করে অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন কিটের মানোন্নয়ন কাজে হাত দেন তারা। গবেষক দলের প্রধান ড. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র-আরএনএ বায়োটেক লিমিটেডের গবেষণাগারে রাত-দিন চলে গবেষণা।
এ প্রসঙ্গে ড. বিজন কুমার শীল মঙ্গলবার (১ সেপ্টেম্বর) সারাবাংলাকে বলেন, ‘অ্যান্টিবডি কিটের জন্য যে শর্তগুলো বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো অনুসরণ করে আমরা কিটের মানোন্নয়ন করেছি। আশা করছি, কয়েকদিনের মধ্যেই অ্যান্টিবডি কিটের ট্রায়াল শুরু করতে পারব। কিটের এক্সটার্নাল ট্রায়াল যথারীতি বিএসএমএমইউতে হবে। ইন্টারনাল ট্রায়াল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে হবে।
এর আগে, গত ২৫ জুন বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে জানিয়ে দেওয়া হয় অ্যান্টিবডি কিটের সংবেদনশীলতা (সেনসিটিভিটি) ও নির্দিষ্টকরণের (স্পেসিফিসিটি) ন্যূনতম সীমা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় (যথাক্রমে ৯০ ও ৯৫ শতাংশ) না হওয়ায় রেজিস্টেশন আবেদন নামঞ্জুর করা হয়েছে। তবে অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের জন্য মার্কিন কেন্দ্রীয় ওষুধ সংস্থা ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) নির্ধারিত নীতিমালা অনুসরণ করে কিটের মানোন্নয়ন করতে পারলে পুনঃআবেদনের সুযোগ নিতে পারবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও করা হবে।
আরও পড়ুন-
- গণস্বাস্থ্যের অ্যান্টিজেন কিটে ত্রুটি!
- নিবন্ধন পাচ্ছে না গণস্বাস্থ্যের অ্যান্টিবডি কিট
- যে কারণে নিবন্ধন পাচ্ছে না গণস্বাস্থের অ্যান্টিবডি কিট
- অ্যান্টিবডি কিট: হাল ছাড়ছেন না গণস্বাস্থ্যের বিজ্ঞানীরা
- ‘করোনার ব্যাপ্তি দেখতে কাজে লাগতে পারে গণস্বাস্থ্যের কিট’
- ‘নমুনা সংগ্রহে জটিলতা, অ্যান্টিজেন কিটে আসছে না পূর্ণ ফল’
ঔষধ প্রশাসনের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী এফডিএ’র নীতিমালা অনুসরণ করে অ্যান্টিবডি কিটের মানোন্নয়ন করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এর পর গত ৫ জুলাই প্রয়োজনীয় নথিসহ ঔষধ প্রশাসনের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ প্রকল্পের তিন বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল, ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার ও ড. নিহাদ আদনান।
ওই বৈঠকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা ঔষধ প্রশাসনকে জানান, ইন্টারনাল ভ্যালিডেশনের মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হয়েছেন তাদের অ্যান্টিবডি কিটের সেনসিটিভিটি এখন ৯৭ শতাংশ। অতএব ইন্টারনাল ভ্যালিডেশনের ভিত্তিতে যেন অ্যান্টিবডি কিটের অস্থায়ী অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু ঔষধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এক্সটার্নাল ভ্যালিডেশন করাতেই হবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক উদারাময় রিসার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)-কে ডেডিকেটেড করা হয়।
কিন্তু মার্কিন কেন্দ্রীয় ওষুধ সংস্থা ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) নির্ধারিত নীতিমালা অনুসরণ করে অ্যান্টিবডি কিটের ভ্যালিডেশনের জন্য যে কারিগরি ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার, সেটি আইসিডিডিআরবির ছিল না। এমন বাস্তবতায় ঔষধ প্রশাসনকে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। তখন ঔষধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে বলা হয় অ্যান্টিবডি কিটের ‘প্যানেল টেস্ট’ করিয়ে আনতে। কিন্তু প্যানেল টেস্ট করার জন্য যে মেশিন দরকার, সেটা বাংলাদেশে নেই। আমেরিকাসহ উন্নত দুই/তিনটি দেশে এই মেশিন আছে। প্যানেল টেস্ট করতে হলে কিট নিয়ে আমেরিকা যেতে হবে। অথবা আমেরিকা থেকে মেশিন কিনে আনতে হবে। এগুলোর কোনোটিই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পক্ষে তখন সম্ভব হয়নি। তারা অপেক্ষা করেছে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এখন তারা বিএসএমএমইউতে কিটের ট্রায়াল শুরু করতে যাচ্ছে।
এদিকে অ্যান্টিবডি কিটের ট্রায়াল বা এক্সটার্নাল ভ্যালিডেশনের একটা গতি হলেও অ্যান্টিজেন কিটের ভ্যালিডেশনের কোনো গতি করতে পারেনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। কারণ, গত ১২ জুলাই অ্যান্টিজেন কিটের জন্য যে নীতিমালা তৈরি করেছে ঔষধ প্রশাসন, সেটির আলোকে ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ অ্যান্টিজেন কিটের মানোন্নয় বাংলাদেশে সম্ভব না। এটা কেবল মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিডিসি অথবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিজস্ব গবেষণাগারে করা সম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে গণস্বাস্থ্যের বিজ্ঞানীরা তাদের অ্যান্টিজেন কিট নিয়ে ভিন্ন চিন্তা করছেন।
সূত্রমতে, বাংলাদেশে যেহেতু অ্যান্টিজেন কিটের মানোন্নয়ন নিয়ে গবেষণা কঠিন হয়ে পড়েছে সেহেতু বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে যেতে চান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। এ জন্য চলতি সেপ্টেম্বরেই বিশ্বের অন্তত পাঁচটি প্রথম সারির জার্নালে নিজেদের গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। কেননা অতীতে এ ধরনের একটি বিষয় নিয়ে ফ্রান্সের একটি জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ লেখার পর সিঙ্গাপুর সরকারের কাছ থেকে ড. বিজন কুমার শীলের কাছে প্রস্তাব আসে সে দেশে গিয়ে গবেষণা করার জন্য। তারপর ২০০২ সালে তিনি সিঙ্গাপুর চলে যান। সেখানে গিয়ে সার্স ভাইরাস শনাক্তকরণ কিট আবিষ্কার করেন ড. বিজন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ‘জিআর কোভিড-১৯ র্যাপিড ডট ব্লট কিট প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়ক ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, “আমাদের যেভাবে ‘ঝুলিয়ে’ রেখেছে তাতে এ দেশে অ্যান্টিজেন কিট নিয়ে গবেষণা করা রীতিমতো অসম্ভব। এখন আমরা বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন চিন্তা করছি। অ্যান্টিজেন কিট নিয়ে আমাদের যে গবেষণা, এটি আমরা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করতে চাই। এ সেপ্টেম্বরেই বিশ্বের প্রথম সারির অন্তত পাঁচটি জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের ইচ্ছা আছে আমাদের।”
ড. বিজন কুমার শীল বলেন, ‘অ্যান্টিজেন কিট নিয়ে গবেষণার জন্য যে নীতিমালা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে, সেটি এ দেশে সম্ভব না। ওটা আমেরিকার সিডিসি বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় সম্ভব। গবেষণার জন্য যে রিএজেন্টগুলো প্রয়োজন, সেটা আমাদের হাতের কাছে নেই। ওটা অস্ট্রেলিয়া থেকে আনতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি রিএজেন্টগুলো আনতে। দেখা যাক কী হয়।’
অ্যান্টিজেন অ্যান্টিবডি ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ট্রায়াল ড. বিজন কুমার শীল ভিন্ন চিন্তা শিগগিরই