Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘ওসি’ প্রদীপ ও স্ত্রীর ৪ কোটি টাকার সম্পদ অবরুদ্ধ করতে চায় দুদক


২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৩:৫৭

চট্টগ্রাম ব্যুরো: কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ এবং তার স্ত্রী চুমকি কারণের মালিকানায় থাকা চার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ করার জন্য আদালতে আবেদন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রদীপ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে চার কোটি ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৭৯ টাকার সম্পদ অর্জন করে স্ত্রীর নামে হস্তান্তর ও স্থানান্তরের অভিযোগে দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল।

বিজ্ঞাপন

ওই মামলায় উল্লিখিত অবৈধ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ করার জন্য রোববার (২০ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শেখ আশফাকুল আলমের আদালতে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারি পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন। আদালত আবেদনটি আদেশের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছেন বলে জানিয়েছেন দুদকের কৌঁসুলি মাহমুদুল হক।

অভিযুক্ত প্রদীপ কুমার দাশ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের উত্তর সারোয়াতলী গ্রামের মৃত হরেন্দ্র লাল দাশের ছেলে। নগরীর কোতোয়ালী থানার পাথরঘাটা আর সি চার্চ রোডে তাদের নিজস্ব একটি আবাসিক ভবন আছে। সেই ভবনে তার স্ত্রী চুমকি কারণ সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন।

গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ওই ঘটনায় সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস গত ৫ আগস্ট কক্সবাজারের একটি আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেন, সেখানে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকতসহ নয়জনকে আসামি করা হয়। মামলাটি তদন্ত করছে র‌্যাব। ওই মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করার পর প্রদীপকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। প্রদীপ এখন কারাগারে আছেন।

এই ঘটনার পর গত ২৩ আগস্ট দুদক কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন বাদি হয়ে প্রদীপ ও চুমকির বিরুদ্ধে চার কোটি ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৭৯ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের একটি মামলা দায়ের করেন। দুদকের অভিযোগ— উল্লিখিত অর্থের মধ্যে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকা ‘ওসি প্রদীপ’ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন। আরও ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার অবৈধ সম্পদ তাদের মালিকানায় আছে যা তারা সম্পদের তথ্য বিবরণীতে গোপন করেছেন।

বিজ্ঞাপন

ওই মামলায় দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রদীপের উপস্থিতিতে শুনানি করে তাকে গ্রেফতার দেখানোর আদেশ দেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ। এরপর রোববার (২০ সেপ্টেম্বর) দুদক ‘অবৈধভাবে অর্জিত’ তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ করার জন্য আদালতে আবেদন করে। একইদিন প্রদীপের পক্ষে জামিন, স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও কারাগারে তার সঙ্গে আইনজীবীদের সাক্ষাতের বিষয়ে পৃথক তিনটি আবেদনের ওপর মহানগর দায়রা জজ আদালতে শুনানি হয়েছে।

দুদকের কৌঁসুলি মাহমুদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আদালতে প্রদীপের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন। স্বাস্থ্যপরীক্ষা এবং কারাগারে তার আইনজীবীদের সাক্ষাতের বিষয়ে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সম্পদ ক্রোকের একটি আবেদন জমা হয়েছে। আদালত সেটি আদেশের জন্য অপেক্ষমান রেখেছেন।’

আবেদনে প্রদীপ ও চুমকির হেফাজতে থাকা ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬০৪ টাকার স্থাবর সম্পদের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে— রেজিস্ট্রেশন খরচসহ ১৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা দামের একটি পুরনো মাইক্রোবাস, ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা দামের একটি পুরনো প্রাইভেট কার, বেসিক ব্যাংকের আসাদগঞ্জ শাখায় রক্ষিত ১৭ লাখ ৭৩ হাজার ৬০৪ টাকা।

একই আবেদনে তিন কোটি ৬৬ লাখ ২৪ হাজার ৪৭৫ টাকার অস্থাবর সম্পদের কথা উল্লেখ আছে। এর মধ্যে আছে নগরীর কোতোয়ালী থানার পাথরঘাটায় ২ কোটি ১৭ লাখ ২৬ হাজার ৭০০ টাকা দামের ছয়তলা একটি বাড়ি। এর জমির দাম ৭২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, ভবনের দাম এক কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং রেজিস্ট্রেশন খরচ ১৪ কোটি ২১ লাখ ৭০০ টাকা। এরপর আছে নগরীর পাঁচলাইশ থানার পশ্চিম ষোলশহর এলাকায় এক কোটি ২৯ লাখ ৯২ হাজার ৬০০ টাকা দামের জমির ওপর সাত লাখ টাকা দামের সেমিপাকা ঘর। কক্সবাজারের ঝিলংঝা মৌজায় ১২ লাখ ৫ হাজার ১৭৫ টাকায় একটি ফ্ল্যাটের বিষয়ও উল্লেখ আছে আবেদনে।

দুদকের আবেদনে বলা হয়েছে, উল্লিখিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ স্থানান্তর ও হস্তান্তর হয়ে গেলে রাষ্ট্রের সমূহ ক্ষতির কারণ আছে। এজন্য এসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধকরণপূর্বক দুদকের একজন রিসিভার নিয়োগ প্রয়োজন। এজন্য এসব সম্পদ অবরুদ্ধকরণের জন্য চট্টগ্রাম সদরের সাব রেজিস্ট্রার, বেসিক ব্যাংকের আসাদগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক এবং চট্টগ্রামের বিআরটিএ’র উপ-পরিচালকের প্রতি আদেশ জারি করার আবেদন করেছে দুদক।

২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-২ থেকে চুমকি কারণের কাছে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার নোটিশ পাঠানো হয়। ১২ মে তিনি সম্পদ বিবরণী দুদকে জমা দেন। এতে তিনি ৩ কোটি ৬৬ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা স্থাবর এবং ৪২ লাখ ৮৪ হাজার ৩৯৪ টাকার অস্থাবরসহ মোট ৪ কোটি ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৬৯৪ টাকার সম্পদের তথ্য উল্লেখ করেন। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে চুমকি কারণের নামে ৩ কোটি ৬৬ লাখ ২৪ হাজার ৪৭৫ টাকার স্থাবর এবং ৫৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৯৪ টাকার অস্থাবরসহ মোট ৪ কোটি ২২ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬৯ টাকার সম্পদের হিসাব উঠে আসে। এ হিসেবে এজাহারে ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়।

প্রদীপ ও ‍চুমকির বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সম্পদ বিবরণীতে চুমকি কারণ তার বাবার কাছ থেকে দান হিসেবে পাওয়া জমিসহ একটি ছয়তলা বাড়ির তথ্য দেন। দুদক অনুসন্ধানে পেয়েছে, চুমকির কারণের বাবা সাবরেজিস্ট্রি দলিলমূলে তাকে বাড়ি দিলে তার অপর দুই ভাই ও এক বোনকে কোনো বাড়ি দেননি। অথচ দুই ছেলের নামে উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পদও নেই। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ওসি প্রদীপ তার ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অপরাধলব্ধ অর্থ গোপন করার অসৎ উদ্দেশে স্থানান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে তার শ্বশুরের নামে বাড়ি নির্মাণ করে পরবর্তীতে তার স্ত্রী চুমকি কারণের নামে দান করিয়ে নিয়ে ভোগদখল করছেন।’

দুদক তাদের সংগ্রহ করা বিভিন্ন নথি পর্যালোচনা করে জানতে পেরেছে, চুমকি কারণ একজন গৃহিণী। তিনি কমিশন ব্যবসায়ী হিসেবে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রথম আয়কর রিটার্ন প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি মাছের ব্যবসা ও বাড়ি ভাড়া থেকে আয় দেখিয়ে রিটার্ন দাখিল করে আসছেন। ২০১৩-১৪ বছরে তিনি ১১ লাখ ২০ হাজার টাকা ও পরবর্তী অর্থবছরে তিনি ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূলধন দেখিয়েছেন। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে কমিশন ব্যবসার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। চুমকি কারণ কমিশন ব্যবসার লাইসেন্স, ব্যাংকে লেনদেনের কোনো প্রমাণ এবং সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে ব্যবসা করার জন্য যথাযথ অনুমোদন দেখাতে পারেননি।

সম্পদ বিবরণীতে চুমকি কারণ মাছের ব্যবসা থেকে দেড় কোটি টাকা আয় দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি ২০০২ সালে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের উত্তর সারোয়াতলী গ্রামে পাঁচটি পুকুর ইজারা বরাদ্দ নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু দুদক অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে, চুমকি কারণ একজন গৃহিণী এবং তার স্বামী প্রদীপ কুমার দাশ ১৯৯৫ সালে পুলিশের উপ-পরিদর্শক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। ২০০২ সালে তাদের ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা সঞ্চিত অর্থ ছিল না। ২০০২ সাল থেকে মাছের ব্যবসা থেকে আয় করার কথা বলা হলেও আয়কর রিটার্নে তিনি সেটা উল্লেখ করেননি। এতে দুদকের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, মাছের ব্যবসা থেকে দেড় কোটি টাকা আয়ের বিষয়টি সঠিক নয়। চুমকি কারণ তার স্বামী প্রদীপের অপরাধলব্ধ অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরের উদ্দেশে ভূয়া মাছের ব্যবসা দেখিয়েছেন।

সম্পদ বিবরণী এবং সংগ্রহ করা নথিপত্র পর্যালোচনায় দুদক আরও পেয়েছে, চুমকি কারণ মোট ৪ কোটি ২২ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬৯ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। একই সময়ে তিনি ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পারিবারিক ব্যয়সহ অন্যান্য ব্যয় করেছেন। এ হিসেবে তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে, ৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৮ হাজার ৮৬৯ টাকা। দুদক তার বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয় পেয়েছে ৪৯ লাখ ১৩ হাজার ২৩৪ টাকা। এক্ষেত্রে তার জ্ঞাত আয়ের উৎসবর্হিভূত সম্পদের পরিমাণ হচ্ছে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকা।

মামলার এজাহারে চুমকি কারণকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তিনি স্বামী ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অপরাধলব্ধ অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরপূর্বক একে অপরের সহযোগিতায় ভোগদখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

মামলায় আসামি চুমকি কারণ ও প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭ (১), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২) ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় অভিযোগ এনেছেন বাদি।

আরও পড়ুন:

অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলো ‘ওসি’ প্রদীপকে

চট্টগ্রাম কারাগারে ওসি প্রদীপ, দুদকের মামলায় হাজিরা সোমবার

৪ কোটি টাকার হিসাব দেখাতে পারেনি প্রদীপ দম্পতি

ওসি প্রদীপ দুদক

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর