Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খাদ্য সংকটে লোকালয়ে আসছে লাউয়াছড়ার প্রাণী, পিটিয়ে মারছে মানুষ


২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৮:৪০

মৌলভীবাজার: খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ায় প্রায়ই বন ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে মানুষের হাতে ধরা পড়ছে লাউয়াছড়ার অজগরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী। লোকালয়ে ছাগল খেতে গিয়ে গত কয়েক মাসের ব্যাবধানে মানুষের হাতে ধরা পড়েছে বিশাল আকৃতির একাধিক অজগর। সাপগুলো দেখার পরই মেরে ফেলার উদ্যোগ নেয় স্থানীয়রা। তবে খবর পেয়ে বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন’ সেগুলো সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে আবার বনে ছেড়ে দেয়।

বিজ্ঞাপন

এসব বন্য প্রাণীগুলো মাঝে মধ্যে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও বেশির ভাগ সময়ই তা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে লোকালয়ে ঢোকা মাত্রই স্থানীয়দের হাতে মারা পড়ছে। এছাড়া লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে বয়ে চলা রেল ও সড়ক পথেও মারা যাচ্ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী।

দেশের চিরহরিৎ বনাঞ্চল হিসেবে খ্যাত মৌলভীবাজকের জেলার কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলের একাংশে অবস্থিত দেশের একমাত্র রেইন ফরেস্ট রিসোর্ট লাউয়াছড়া। ১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমি নিয়ে লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার মধ্যেবর্তী স্থানে এই লাউয়াছড়া উদ্যানের অবস্থান। লাউয়াছড়ায় ৪৬০ প্রজাতির জীববৈচিত্র্যের মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, চার প্রজাতির উভচর প্রাণী, ছয় প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং ১৭ প্রজাতির পোকামাকড় রয়েছে। নানান সমস্যা ও সংকটে এখানকার প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যগুলো এখন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে।

মানবসৃষ্ট সংকটে ঐতিহ্য ধরে রাখতে হিমশিম খাওয়া এই উদ্যানটি এখন অনেকটাই ধ্বংসের প্রান্তে। তবে চলমান এ সংকট নিরসনে নেই কোনো মহাপরিকল্পনা কিংবা স্থায়ী উদ্যোগ। নানা কারণে দীর্ঘদিনের বয়ে চলা সংকটগুলো ঘনীভূত হয়ে এখন মহা হুমকিতে পড়েছে ওখানকার নানা দুর্লভ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বাসস্থান, জীবন-জীবিকা ও পরিবেশ। প্রতিনিয়তই খাদ্য, নিরাপদে অবাদ বিচরণ ও বাসস্থানের আয়তন ছোট হচ্ছে ওই সকল বন্যপ্রাণীদের। আর এ কারণেই দিন দিন পরিসংখ্যানও কমছে ওখানে ঠাঁই নেওয়া বিশ্বের বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের।

বিজ্ঞাপন

বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ শাখার হিসাব বলছে, লাউয়াছড়া বনের ভেতর ও আশপাশ এলাকা থেকে চলতি বছরের প্রথম আট মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ৫০টি বন্যপ্রাণী। এর মধ্যে সাতটি মৃত। ২০১৭ সালে উদ্ধার করা ১৮৭টি বন্যপ্রাণীর মধ্যে মৃত পাওয়া যায় ১৬টি। তবে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে সবচেয়ে বেশি বন্যপ্রাণী মারা পড়ে ২০১৬ সালে। সে বছর মোট ২৩০টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ৪৭টিই ছিল মৃত।

আরও পড়ুন: নির্বিচারে ধ্বংস হচ্ছে লাউয়াছড়া, সংকটে বিলুপ্তির পথে প্রাণীকূল

লাউয়াছড়া বন ও বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করছে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তির মতে বন বিভাগের হিসাবের কয়েক গুণ বেশি বন্যপ্রাণী প্রতি বছর মারা পড়ছে এমনটিই জানিয়েছেন তারা।

এসব ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মতে, বন্যপ্রাণী মারা যাওয়ার খুব কম তথ্যই বন বিভাগ পেয়ে থাকে। এলাকাবাসী ভয়ে বন বিভাগকে এসব তথ্য দিতে চায় না বলেও জানান তারা।

বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের হিসাবমতে, গত ছয় মাসে লাউয়াছড়ার আশপাশে অন্তত ২০টি বন্যপ্রাণী মারা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে মায়া হরিণ, সজারু, বনরুই, গন্ধগোকুল, অজগরসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ও বানর। চলতি বছর ফাউন্ডেশনটি বন থেকে লোকালয়ে ঢুকে পড়া ৪০টি প্রাণী আহত ও সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু বন্য প্রাণী লাউয়াছড়ায় অবমুক্ত করা হয়েছে।

প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন লাউয়াছড়ায় বন্যপ্রাণী মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে বয়ে চলা সড়ক ও রেল পথকেই দায়ী করছেন! মোনায়েম খান বলেন, ‘অতিমাত্রায় পর্যটকের আগমন, বনে গভীরে গিয়ে পর্যটকদের হই হুল্লোড়, বনের ভেতরকার সড়ক দিয়ে বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের জন্য নিজের আবাসস্থলকে অনিরাপদ ভেবে লোকালয়ে চলে যাচ্ছে বন্যপ্রাণীরা।’ তিনি আরও বলেন, ‘সচেতনতার অভাবে লোকালয়ে গিয়ে ধরা পড়া বন্যপ্রাণীর একটা বড় অংশই মারা পড়ছে মানুষের হাতে। তবে বন্যপ্রাণী প্রেমি খোকন সিং বলেন, ‘দিন দিন লাউয়াছড়া দখল হয়ে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে গেছে। ফলে তারা লোকালয়ে খাদ্যের সন্ধানে গিয়ে ধরা পড়ছে কিছু উদ্ধার হচ্ছে আবার মানুষের হাতেও মারা যাচ্ছে।‘

বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্যে ভরপুর এ লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রেলপথ। পাশাপাশি বনের ভেতর দিয়ে রয়েছে সড়কপথও। এ দুই পথে ট্রেন আর গাড়ির চাপায় প্রায় প্রতিনিয়তই মারা যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্যপ্রাণী। আহত হচ্ছে আরও বেশি।

বাপার মৌলভীবাজার জেলার সমন্বয়ক আ ন ম সালেহ সুহেল বলেন, ‘একটি সংঘবদ্ধ চোর চক্র নির্বিচারে বনের গাছ উজাড় করায় বন্যপ্রাণীর খাদ্য সংকট চরম আকারে দেখা দিয়েছে। বনের ভেতরে পর্যটকদের গাড়ি চলাচল উচ্চ শব্দে মাইক বাঝানোসহ বনের গভীরে পর্যটকদের আনাগোনা বন্ধ করা প্রয়োজন। এছাড়া বনের গা ঘেঁষে, অনেক ক্ষেত্রে বনের জমি দখল করে লেবু বাগান, ঘরবাড়ি ও দোকানপাট নির্মাণ, পর্যটকদের বনের ভেতর অবাধে প্রবেশ করে হই-হুল্লোড় ও বনের ভেতর দিয়ে যানবাহন চলাচলের কারণেও প্রাণীদের নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে।‘

একাত্তর টেলিভিশনের সিনিয়র ওয়াইল্ড লাইফ জার্নালিস্ট হোসেন সোহেল বলেন, ‘বন্যপ্রাণীরা লোকালয়ে আসতে চায় না, তিনি বলেন আমরাই দিনের পর দিন বন-জঙ্গল ধ্বংস করে তাদের আবাসস্থল দখল করে ব্যাক্তি স্বার্থে নিজেদের জন্য আবাস গড়ছি। শুধু তাই নয় লাউয়াছড়ার বনের ভেতরে বনে জায়গা দখল করে প্রচুর লেবু ও আনারস বাগান গড়ে উঠেছে। এসব বাগানে আবার ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিকেলও ফলে লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ছড়ার পানিতে এসব বিষাক্ত কেমিকেল পানির সঙ্গে মিশে দূষিত হচ্ছে। এসব ছড়ার পানি পান করেও অনেক প্রাণী মারা যাচ্ছে। আর প্রতিনিয়তই একশ্রেণির প্রভাবশালীদের দখলের কারণে বন্যপ্রাণীদের আবাস্থল সংকুচিত হচ্ছে পাশাপাশি দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট।’

হোসেন সোহেল বলেন, বনের গাছ কেটে পাচারের ফলে তাদের আবাস ও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে তারা প্রায়শই খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে চলে যাচ্ছে। নিজেদের প্রয়োজনেই এসব বন্যপ্রাণী ও বন আমাদের রক্ষা করা প্রয়োজন। বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় এখনো মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে সচেতনতা তৈরি হয়নি। ফলে লোকালয়ে আসা বন্যপ্রাণীকে অনেকেই সচেতনতার অভাবে হত্যা করছে। লাউয়াছড়া বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় গণমাধ্যমকর্মীসহ স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে নিয়ে দ্রুতই সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

লাউয়াছড়া বন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর এ পর্যন্ত লাউয়াছড়ার প্রায় ৩০ শতাংশ গাছ কমেছে। এর বেশির ভাগ অংশই চোরাকারবারিরা কেটে নিয়ে গেছে। এছাড়া ঝড়েও উপড়ে পড়েছে কিছু। গাছ পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব ও নতুন করে বনায়নের উদ্যোগ না নেওয়ায় কমছে গাছগাছালি ফলে চরম সংকটে পড়ছে বন্যপ্রাণী।

লাউয়াছড়ায় বন্যপ্রাণীর খাদ্য ও আবাস সংকটের কথা স্বীকার করছে বন বিভাগও। সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) আ ন ম আব্দুল ওয়াদুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘খাদ্য ও আবাস সংকটে লোকালয়ে এসে অনেক বন্যপ্রাণী মারা পড়ছে। এ সংকট নিরসনে বনাঞ্চলে বিভিন্ন জাতের ফলমূলের গাছ লাগানোর পাশাপাশি বড় গাছ সংরক্ষণ করা হবে। এছাড়া উদ্যানের ভেতর বন্যপ্রাণীর জন্য একটি রেসকিউ সেন্টার করা হয়েছিল। লোকবলের অভাবে সেটি বন্ধ আছে। এটিও চালু করা হবে। বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তায় বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া রেললাইন ও সড়কপথের বিকল্প চিন্তা করাও প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

বন বিভাগের হিসাবমতে, লাউয়াছড়া বনে ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫৯ প্রজাতির সরীসৃপ (৩৯ প্রজাতির সাপ, ১৮ প্রজাতির লিজার্ড ও দুই প্রজাতির কচ্ছপ), ২২ প্রজাতির উভচর, ২৪৬ প্রজাতির পাখি ও অসংখ্য কীট-পতঙ্গ রয়েছে। বিরল প্রজাতির উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান ও চশমাপরা হনুমানও দেখা যায় সংরক্ষিত এ বনে। এর বাইরেও রয়েছে বানর, মেছোবাঘ, বন্য কুকুর, ভালুক, মায়া হরিণ, বনছাগল, কচ্ছপ, অজগরসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। পাখির মধ্যে আছে সবুজ ঘুঘু, বনমোরগ, মথুরা, তুর্কি বাজ, সাদা ভ্রু সাতভায়ালা, ঈগল, হরিয়াল, কালো মাথা টিয়া, কালো ফর্কটেইল, ধূসর সাতশৈলী, পেঁচা, ফিঙে, লেজ কাটা টিয়া, কালোবাজ, হীরামন, কালো মাথা বুলবুল ও ধুমকল। সাধারণ দর্শনীয় পাখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য টিয়া, ছোট হরিয়াল, সবুজ সুইচোরা, তোতা, ছোট ফিঙে, সবুজ কোকিল, পাঙ্গা ও কেশরাজ।

বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির অনেকগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা। বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া রেলপথ ও সড়কপথকেই বন্যপ্রাণীর জন্য মরণফাঁদ হিসেবে মনে করেন বন্যপ্রাণীপ্রেমী এবং ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার খোকন সিং। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই বনের মধ্য থেকে সড়ক ও রেলপথ স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে আসছে সচেতন মহল। এগুলো স্থানান্তর করা না গেলে কোনোভাবেই বন্যপ্রাণী রক্ষা করা যাবে না। আর লাউয়াছড়ার ভেতর বন বিভাগের একটি রেসকিউ সেন্টার থাকলেও সেটিও বর্তমানে লোকবল সংকটে রুগ্ন দশায় ভুগছে।এই রেসকিউ সেন্টারের কার্যক্রম চালু থাকলে বন্যপ্রাণী মৃত্যুহার অনেকটা কমে যেত।

খাদ্য সংকট পিটিয়ে হত্যা প্রাণী মৌলভীবাজার লাউয়াছড়া লোকলয়

বিজ্ঞাপন

খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমলো
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২১:০৮

আরো

সম্পর্কিত খবর