পাওনা আদায়ে আন্দোলন, ড্রাগন সোয়েটারের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা!
১৪ অক্টোবর ২০২০ ২১:৩৮
ঢাকা: করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারিকে পুঁজি করে রাজধানীর মালিবাগের ড্রাগন সোয়েটারের প্রায় ৫০০ শ্রমিককে চাকরিচুত্য করা হয়েছিল। লকডাউন শুরু হলে ২৬ মার্চ থেকে কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর আর এই শ্রমিকরা আর কারখানাটিতে প্রবেশ করতে পারেননি। তবে ওই সময় থেকেই আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। সার্ভিস বেনিফিট ও প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ ন্যায্য পাওনার দাবিতে মানববন্ধন, সমাবেশ, দেনদরবার— এমন কিছু নেই, যা তারা করেনি।
পাওনা বঞ্চিত শ্রমিকরা বিজয়নগরের শ্রম ভবনের সামনে অনশন ও ঝাড়ু মিছিল করেছেন। সরকারের বিভিন্ন দফতরে স্মারকলিপি পর্যন্ত দিয়েছেন। তবু শ্রমিকদের দাবি মানেননি কারখানাটির চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস। ‘ওসি কুদ্দুস’ নামে পরিচিত এই ব্যবসায়ী তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি।
দাবি না মানলেও শ্রমিকরা কারখানাটির সামনে গত ৪ অক্টোবর মানববন্ধন করলে সেখানে হামলা চালানো হয়। শ্রমিকদের অভিযোগ, মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের শ্যালক শাহাদাতসহ মালিকপক্ষের অনুসারীরা তাদের ওপর হামলা চালান। আর তারা হামলাতেই ক্ষান্ত হননি, বরং শ্রমিকদের বিরুদ্ধেই মামলা করেছে মালিকপক্ষ।
শ্রমিকরা বলছেন, আন্দোলন স্থিমিত করতে এবং তাদের হয়রানি করতেই মামলা করা হয়েছে। আর প্রায় ছয় মাস ধরে বিভিন্ন পক্ষের দেনদরবার হলেও সর্বশেষ ন্যায্য পাওনার অর্ধেক চার কিস্তিতে পরিশোধ করতে সম্মত হয়েছে মালিকপক্ষ।
আরও পড়ুন- আইন মানে না ড্রাগন সোয়েটার, পাওনা চাইলে চাকরি যায় শ্রমিকের
জানা গেছে, গেল ২৬ মার্চ ড্রাগন সোয়েটার কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা ৫০০ শ্রমিককে কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই চাকরিচুত্য করা হয়। মালিবাগের এই কারখানাটি কুমিল্লায় সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। পরে অবশ্য সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে মালিকপক্ষ। বর্তমানে দৈনিক ভিত্তিতে লোক নিয়োগ দিয়ে কারখানাটি পরিচালনা করা হচ্ছে। শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা না দিতে দীর্ঘদিন এই কারখানাটি অন্য নামে চালানো হচ্ছিল বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে, শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে সার্ভিস বেনিফিট ও প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ ন্যায্য পাওনা আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন। দফায় দফায় তারা মানববন্ধন করেছেন মালিবাগে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনেও দাবি আদায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। শ্রম ভবনের সামনে অনশন, মানববন্ধন ও ঝাড়ু মিছিল করেছেন। মালিকের বাড়ি ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও দিয়েছিলেন শ্রমিকরা। এর ধারাবাহিকতায় গত ৪ অক্টোবর মালিবাগে তারা মানববন্ধন করেন। শ্রমিকদের অভিযোগ, সেখানে মালিকপক্ষ ও তাদের ভাড়াটে গুণ্ডারা তাদের ওপর হামলা চালায়। ব্যানার ও ফেস্টুন কেড়ে নেয়। পরে দীর্ঘদিন ধরে এই আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, সেসব শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে মালিকপক্ষ।
জানা গেছে, গত ৫ অক্টোবর ড্রাগন সোয়েটারের অ্যাডিমন অফিসার মাহবুবুর রহমান বাদী হয়ে ১৬ জন শ্রমিকের নাম উল্লেখ করে হাতিরঝিল থানায় মামলাটি দায়ের করছেন। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ৩০ জন শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে ওই মামালাতে।
মামলার এজহারে বলা হয়েছে, ৪ অক্টোবর পূর্বনির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের চার জন কর্মকর্তা আমাদের কারখানা পরির্দশন করেন। পরিদর্শন চলাকালে আমাদের প্রতিষ্ঠানের সাবেক কিছু কর্মকর্তা/কর্মচারী, যারা দীর্ঘদিন ধরে গোলযোগ করে আসছিল, তারা বেআইনিভাবে একতাবদ্ধ হয়ে লাঠি, লোহার রড, ছুরি, কিরিচ, ইট-পাথর ইত্যাদি নিয়ে কারখানায় প্রবেশ করে এবং নিচে কর্মরত আমাদরে কারখানার কর্মকর্তা/কর্মচারীদের মারধর করে মারাত্মক জখম করে।
আরও পড়ুন- ড্রাগন সোয়েটারে ১০ মাসের বেতন পাওনা কর্মচারীদের
এজাহারে সাত জন কর্মকর্তা কর্মচারীকে মারধরের কথা উল্লেখ করা হয়। মামলায় যাদের আসামী করা হয়েছে তারা হলেন— মো. আব্দুল কুদ্দুস, শুক্কুর চৌধুরী, ফারুক ভূঁইয়া, মিন্টু মিয়া, হাসানুর রহমান, আল আমিন, শাহ আলম, মনির হোসেন, রশিদ মিয়া, আ. রাজ্জাক, মফিজুল ইসলাম, সোহেল রানা, উজ্জল সিকদার, শাহিন কবির, মো. নান্নু ফকরি ও মঞ্জুর মইন।
কারখানাটির শ্রমিক আব্দুল কুদ্দুস সারাবাংলাকে বলেন, আমরা মালিবাগে শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের কর্মসূচি পালন করছিলাম। মালিবাগ ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে মালিবাগ রেল গেট পর্যন্ত ওই মানববন্ধনের পরিধি ছিল। পুলিশ সেখানে দায়িত্ব পালন করছিল। এসময় ড্রাগন গ্রুপের মালিকের সুবিধাপ্রাপ্ত কিছু সন্ত্রাসী বাহিনী লাঠিসোটা, রড, কিরিচসহ নানা রকম অস্ত্র নিয়ে পুরো মালিবাগ এলাকায় টহল দিতে থাকে। অস্ত্রধারী এই সন্ত্রাসীরা সাবেক সিটি ডেন্টাল কলেজের ভেতরের গলিতে ঢাকা হোম নামের বাড়ির সামনে থেকে চাকুরিচ্যুত শ্রমিকদের মারধর করে ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে যায়। এরপর আমরা পুলিশের উপস্থিতি মালিবাগ রেল গেট সংলগ্ন রাস্তার পাশে ফুটপাতের ওপর শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে দাঁড়াই।
আব্দুল কুদ্দুস আরও বলেন, শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন চলাকালে মালিক মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের শ্যালক শাহাদাতসহ গুণ্ডা বাহিনীরা এসে শ্রমিকদের ওপর হামলা করে। কয়েকজন নারী শ্রমিককেও শ্লীলতাহানি করে। পথচারী ও সাধারণ শ্রমিকরা শাহাদাতকে ধরে দায়িত্বরত পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। অন্য সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। আর মালিক মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস চাকরিচ্যুত শ্রমিক কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা না দেওয়ার জন্য নিরীহ শ্রমিক কর্মচারীদের নামে মিথ্যা মামলা করেছে।
তিনি বলেন, মামলার এজাহারে উল্লেখ আছে শ্রমিকরা কারখানার গেট ও রিসিপশনে গিয়ে ভাংঙচুর করেছে। কারখানার গেট ও রিসিপশন এলাকায় ১৫ থেকে ২০টি সিসি ক্যামেরা আছে। আমরা কারখানার সিসিটিভি ফুটেজ ও আশপাশের এলাকার ফুটেজ দেখার দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে, ড্রাগন সোয়েটার লিমিটেড কারখানার শ্রমিকদের চলমান শ্রম অসন্তোষ নিরসনের জন্য ১২ অক্টোবর কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরির্দশন অধিদফতরের মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায়ের সভাপতিত্বে অধিদফতরের সভাকক্ষে মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের একটি সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ওই কারখানার চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুছসহ শ্রমিক ও বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে সবার সম্মতিতে যেসব সিদ্ধান্ত হয়, তার মধ্যে রয়েছে— প্রত্যেক শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে চাকরির ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতিবছর চাকরির জন্য ১৫ দিনের মূল মজুরি মালিক কতৃপক্ষ পরিশোধ করবে; জমা থাকা সাপেক্ষে ২০১৮ সালের পরবর্তী সময়ের জন্য প্রত্যেক শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে বাৎসরিক ছুটির (অর্জিত ছুটি) পাওনা শ্রম আইন অনুযায়ী মালিক কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করবে; মালিকের কাছে সঞ্চিত শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তার সব অর্থ মালিকের কাছে থাকা হিসাব অনুযায়ী মালিক কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করবে। ৭ নভেম্বর, ২২ নভেম্বর, ৭ ডিসেম্বর ও ২২ ডিসেম্বর— এই চার তারিখে চার কিস্তিতে অর্থ পরিশোধ করার বিষয়ে চুক্তি হয় বৈঠকে।
বৈঠকের প্রসঙ্গ জানিয়ে শ্রমিক কুদ্দুস সারাবাংলাকে বলেন, পাওনা আদায়ে শ্রম ভবনে বৈঠক হয়েছে। সেখানে ড্রাগনের মালিক ওসি কুদ্দুস পাওনা পরিশোধে একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছেন। বছরে ১৫ দিনের সার্ভিস বেনিফিট দেওয়ার কথা। টাকাগুলো চার কিস্তিতে পরিশোধ করবেন। আমরা বলেছিলাম মামলা উঠিয়ে নিতে। তিনি জানিয়েছেন, আমরা যেন ঝামেলা করতে না পারি, তাই টাকা পরিশোধের আগে মামলা তুলবেন না।
বৈঠকে উপস্থিত শ্রমিক লীগের সভাপতি ফজলুল হক মন্টু সারাবাংলাকে বলেন, শ্রমিক ও মালিকপক্ষের মধ্যে সোমবার একটি সমঝোতা সই হয়েছে। প্রায় ছয় মাসের সমস্যার সমাধান হয়েছে। শ্রমিকদের নামে যে মামলা করা হয়েছে, সেটি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। শ্রমিকদের যেন হয়রানি করা না হয়, সে বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও হাতিরঝিল থানাকে বলা হয়েছে। শ্রমিকরা তাদের পুরো ন্যায্য পায়নি। কিন্তু মেনে নিতে হয়েছে।
গার্মেন্টস ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, পাওনা আদায়ে একটি চুক্তি হয়েছে। মালিকপক্ষ ন্যায্য পাওনার সবটা না দিলেও অনেকটা আদায় করা যাচ্ছে। আর চুক্তিতে শ্রমিকদের হয়রানি না করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। মালিকপক্ষ মামলা তুলে নেবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি দিলেও তা পূরণ করে না। তাদের বিরুদ্ধে আমাদেরও একটি মামলা আছে। তারা মামলা তুলে নিলেই আমরা আমাদের মামলা তুলে নেব।
এসব বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য ড্রাগনের মালিক মোস্তাফা গোলাম কুদ্দুসকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। আর পুলিশও মামলা বিষয়ে জানাতে পারেনি।
আন্দোলন ড্রাগন সোয়েটার ন্যায্য পাওনা বিক্ষোভ বেতন-ভাতা মানববন্ধন শ্রমিক চাকরিচ্যুত