বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের জামানত হারানোর কারণ জানা নেই ইসির!
১৮ নভেম্বর ২০২০ ১১:৩৯
ঢাকা: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে অনুষ্ঠিত সংসদীয় শূন্য আসনের উপনির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে জামানত হারাচ্ছেন বিএনপির প্রার্থীরা। শুধু বিএনপির প্রার্থী নয়, এসব নির্বাচনে বিরোধীদল জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাও অবিশ্বাস্যরকম কম ভোট পেয়ে জামানত হারাচ্ছেন। সংসদ উপনির্বাচনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বিপরীতে বাকি প্রার্থীরা তাদের জামানত রক্ষা করতে পারছেন না। এ বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের বিভিন্ন শূন্য আসনের উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলোর দাবি, নির্বাচনে কারচুপি হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তবে নির্বাচন কমিশন বলছে, এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটছে তার কোনো কারণ জানা নেই ইসির।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে, সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর মনোনয়নপত্র কেনার সময় জামানত হিসেবে ২৫ হাজার টাকা নির্বাচন কমিশনে জমা রাখতে হয়। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে জামানত ফেরত পেতে হলে সংশ্লিষ্ট আসনে প্রদত্ত ভোটের (কাস্টিং ভোটের) আটভাগের একভাগ ভোট পেতে হয়। কোনো প্রার্থী যদি কাস্টিং ভোটের আটভাগের একভাগ ভোট না পান, তাহলে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। আর এই বাজেয়াপ্ত জামানতের অর্থ জমা হয় সরকারি কোষাগারে জমা হয়।
বিএনপি প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা কেন হচ্ছে সেটা দেখতে হবে। অনুমান করে এ নিয়ে কথা বলা আমার পদ থেকে শোভা পায় না। যদি কোনো তথ্য-উপাত্ত থাকতো তাহলে আমরা বলতে পারতাম। তবে ভোটের এত বেশি ব্যবধান কেন হচ্ছে তা আমাদেরও নজরে আসছে। কেউ যদি অনুসন্ধান করে আমাদের জানায় তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব। কেউ না জানালে আমরা নিজেরা অনুসন্ধান করতে পারি না।’
নির্বাচনে কোনো ধরনের অনিয়মের কারণে এমন হচ্ছে কি না?- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে কোনো ধরনের অনিয়ম হচ্ছে কি না তার তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ ইসিতে নেই। ফলে বিএনপির প্রার্থীরা কেন ভোট কম পাচ্ছে এটা বলা মুশকিল।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সঠিক নির্বাচন হওয়ার পর যদি ভোটের এমন ব্যবধান হয় তাহলে আমাদের চিন্তার কারণ আছে। কারণ হলো- তাহলে আমাদের কোনো বিরোধীদল নেই। আর বিরোধীদল ছাড়া গণতন্ত্র থাকে না। ফলে সংসদেও বিরোধীদল নেই, মাঠেও নেই। ফলে আমরা চরম সংকটের মধ্যে রয়েছি।’ আর যদি সঠিক নির্বাচন না হয় তাহলে উদ্বিগ্ন হওয়ার ব্যাপক কারণ আছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘ইভিএমে ভোট হওয়ার কারণে পুনর্গণনা করারও কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশন যা বলে সেটাই আমাদের মানতে হচ্ছে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। ফলে এই ভোটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।’
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, গত ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদের ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ঢাকা-১৮ আসনে আওয়ামী লীগের হাবিব হাসান ৭৫ হাজার ৮২০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি বিএনপির এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন পেয়েছেন পাঁচ হাজার ৩৬৯ ভোট। এ আসনে মোট ভোট কাস্ট হয়েছে ৮১ হাজার ৮১৮ ভোট। ফলে বিএনপির প্রার্থীর জামানত রক্ষায় দরকার ছিল ১০ হাজার ২২৭ ভোট। সিরাজগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তানভীর শাকিল জয় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৩২৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। এখানে বিএনপির সেলিম রেজা পেয়েছেন মাত্র ৪৬৮টি ভোট। নির্বাচনে মোট কাস্টিং ভোট এক লাখ ৮৮ হাজার ৯৭৩। এক্ষেত্রে প্রার্থীদের জামানত রক্ষায় প্রয়োজন ছিল ২৩ হাজার ৬০০ ভোট। উভয় আসনে বিএনপির প্রার্থীরা জামানত হারিয়েছেন।
অন্যদিকে গত ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ঢাকা-৫ আসনে ভোট পড়ে ৪৯ হাজার ১৪১টি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. কাজী মনিরুল ইসলাম ৪৫ হাজার ৬৪২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। এখানে বিএনপির প্রার্থী সালাউদ্দিন আহমেদ পান মাত্র দুই হাজার ৯২৬ ভোট। জামানত রক্ষায় তার ভোটের দরকার ছিল ছয় হাজার ১৪৩ ভোট। একই দিনে অনুষ্ঠিত নওগাঁ-৬ আসনের উপনির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থীর জামানত রক্ষা হয়নি। ওই আসনে মোট কাস্ট হওয়া ভোট এক লাখ ১১ হাজার ৯৪২। এখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. আনোয়ার হোসেন (হেলাল) এক লাখ পাঁচ হাজার ৫২১ ভোট পেয়ে জয়ী হন। বিপরীতে বিএনপির শেখ মো. রেজাউল ইসলাম পান চার হাজার ৬০৫ ভোট।
এছাড়াও গত ২৬ সেপ্টেম্বর পাবনা-৪ আসনের উপনির্বাচনে দুই লাখ ৫০ হাজার ৬৮৪টি ভোটের মধ্যে বিএনপির হাবিবুর রহমান হাবিব পেয়েছেন পাঁচ হাজার ৫৪৮ ভোট। গত ১৪ জুলাই যশোর-৬ আসনে ১ লাখ ২৯ হাজার ৬৭টি কাস্টিং ভোটের মধ্যে বিএনপির প্রার্থী আবুল হোসেন আজাদ পেয়েছেন মাত্র ২ হাজার ১২ ভোট। একই দিনে অনুষ্ঠিত বগুড়া-১ আসনের উপনির্বাচনে মোট ভোট পড়ে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭৪৬ ভোট। বিএনপির প্রার্থী একেএম আহসানুল তৈয়ব জাকির পান পেয়েছেন মাত্র ৬৬৪ ভোট। গত ২১ মার্চ অনুষ্ঠিত বাগেরহাট-৪ ও ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের জামানত রক্ষা হয়নি।
তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপনির্বাচনে দুটি ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। সেটি হলো- একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পদত্যাগ করা শূন্য আসনে বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করেন। অন্যদিকে ২১ মার্চ অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৩ আসনের উপনির্বাচনে জামানত রক্ষা হয় বিএনপির প্রার্থী মইনুল হাসান সাদিকের। তিনি পান ৪১ হাজার ৪০৮ ভোট।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা ২৫৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত হারান ১৫২টিতে। ওই নির্বাচনে বিএনপির ৬০ শতাংশ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।