Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হিউম্যান ট্রায়ালে যেতে পারেনি গ্লোবের ‘ব্যানকোভিড’, নেই অগ্রগতিও


২৪ নভেম্বর ২০২০ ১৫:১১

ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে এখন পযর্ন্ত সবচেয়ে বেশি আলোচিত শব্দগুলোর একটি ‘ভ্যাকসিন’। বলা চলে, গোটা বিশ্ব উন্মুখ হয়ে আছে এই ভ্যাকসিনের জন্য। বিশ্বের অনেক দেশই করোনার ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বেশকিছুর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ হয়েছে, চলছে তথ্য পর্যালোচনা। এমনকি চারটি প্রতিষ্ঠান তাদের ভ্যাকসিন মানবদেহের জন্য কার্যকর বলে ঘোষণাও দিয়েছে। এখন সেগুলো মানবদেহে প্রয়োগে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অনুমোদন পেলেই বিশ্বব্যাপী বিপণন করবে প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিজ্ঞাপন

এদিকে ভ্যাকসিন তৈরির বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় রয়েছে বাংলাদেশও। দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্লোব বায়োটেকের দাবি, তাদের ভ্যাকসিন প্রাণীদেহে দুই ধাপের পরীক্ষাতেই সফল হয়েছে। ‘ব্যানকোভিড’ নামের এই ভ্যাকসিনটি এবার মানবদেহে প্রয়োগের প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে জানিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এক মাস পেরিয়ে গেলেও তারা এখনও হিউম্যান ট্রায়াল শুরু করতে পারেনি। গ্লোবের কর্মকর্তারাও ভ্যাকসিনের অগ্রগতি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারছেন না।

বিজ্ঞাপন

এর আগে ১৭ অক্টোবর গ্লোব বায়োটেকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. কাকন নাগ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ভ্যাকসিনটি প্রাণীদেহে সফলভাবে পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি। অর্থাৎ আমরা এরই মধ্যে প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করেছি। এখন শিগগিরই হিউম্যান ট্রায়াল শুরু করব। সেজন্য আমরা আইসিডিডিআর’বির সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তিও সই করেছি। বিএমআরসি (মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল) ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর এটা নিয়ে কাজ করছে। আশা করছি, খুব দ্রুতই আমরা মানবদেহে ট্রায়াল শুরু করতে পারব ‘

তবে ২৩ নভেম্বর ড. কাকন নাগ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভ্যাকসিন বিষয়ে এই মুহূর্তে আমাদের কাছে কোনো আপডেট নেই। হয়তোবা এই সপ্তাহের শেষের দিকে আপনাদের কিছু জানাতে পারবো। আইসিডিডিআর’বির সঙ্গে আমাদের একটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছে, যার আপডেট আপনাদের কাছে আছে। এখন পর্যন্ত সেটার পরে আর কোনো অগ্রগতি নেই।’

এ বিষয়ে গ্লোব বায়োটেকের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান ডা. আসিফ মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আসলে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। আমাদের সঙ্গে আইসিডিডিআর’বির একটা সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল। এরপরে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ওদের সঙ্গে আমাদের খুব শিগগিরই এ বিষয়ে কথা হবে। তখন হয়তোবা আমরা অগ্রগতি বিষয়ে কিছু বলতে পারব। কিন্তু প্রায় এক মাস হয়ে গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা না আসায় হয়তোবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আমরা খুব দ্রুত এ বিষয়ে আপডেট জানাতে পারব বলে আশা করছি।’

আরও পড়ুন:

এদিকে আইসিডিডিআর’বি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও প্রতিষ্ঠানটি গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিনের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিনের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিচালক ডা.হাবিবুর রহমান বলেন, ‘যেকোনো নতুন ভ্যাকসিন বা ডিভাইস অ্যাপ্রুভালের জন্য কিছু নিয়ম-নীতি আছে। গ্লোবের ভ্যাকসিন এখনও হিউম্যান ট্রায়াল শুরু করতে পারেনি। তারা যদি এই হিউম্যান ট্রায়াল পর্ব শেষ করে তবে সেই ফলাফলের উপরই নির্ভর করবে তাদের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা।’

হিউম্যান ট্রায়ালে যদি সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া যায় তবে দেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্লোবের ভ্যাকসিন অবশ্যই বিবেচনা করা হবে বলে জানান হাবিবুর রহমান।

এদিকে গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিন বিষয়ে বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘সম্প্রতি গ্লোব বায়োটেক অ্যানিম্যাল ট্রায়াল শেষ করেছে। এটি যেকোনো নতুন ভ্যাকসিনের জন্য প্রাথমিক ধাপ। শুরু হিসেবে এটিকে অবশ্যই ভালো বলতে হবে। কিন্তু হিউম্যান ট্রায়াল শেষ করা ছাড়া আসলে কিছুই বলা যায় না। তাছাড়া এখন পর্যন্ত তাদের গবেষণা কোনো আন্তর্জাতিক জার্নালেও প্রকাশ হয়নি। এটি সম্পূর্ণ নতুন ধরণের ভ্যাকসিন এবং সরাসরি মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত। তাই এটি নিয়ে আগাম মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।’

উল্লেখ্য, ১ জুলাই গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গ্লোব বায়োটেক প্রথম জানায়, তারা দেশেই করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে জন্য কাজ করছে। ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পরই তারা এর ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের কাজ শুরু করে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড ২০১৫ সালে ক্যানসার, আর্থ্রাইটিস, রক্তস্বল্পতা, উচ্চ রক্তচাপ, অটোইমিউন ডিজিজসহ অন্যান্য দুরারোগ্য রোগ নিরাময়ের জন্য বায়োলজিক্স, নভেল ড্রাগ এবং বায়োসিমিলার উৎপাদনের লক্ষ্যে অত্যাধুনিক গবেষণাগার স্থাপনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রয়োজনে গ্লোব বায়োটেক গবেষণার পাশাপাশি কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ কিট, টিকা ও ওষুধ আবিষ্কার সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করে। সিইও ড. কাকন নাগ ও সিওও ড. নাজনীন সুলতানার সার্বিক তত্ত্বাবধানে তারা ‘কোভিড-১৯’ প্রতিরোধে টিকা (ভ্যাকসিন) আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে।

২ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে গ্লোব ঘোষণা দেয়, প্রাণীদেহের ওপর এই ভ্যাকসিনের প্রথম ধাপের ট্রায়াল তারা সফলভাবে শেষ করেছে। পরবর্তী ধাপগুলো ঠিকঠাকমতো শেষ করতে পারলে ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে তারা টিকা বিপণন করতে পারবে। এদিন সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান ডা. আসিফ মাহমুদ প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে এই ভ্যাকসিন সম্পর্কে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সফল হয়েছি। অ্যানিম্যাল পর্যায়ে এটা সফল হয়েছে। আশা করছি, মানবদেহেও সফলভাবে কাজ করবে আমাদের ভ্যাকসিন। আমরা বিষয়টি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে যাব। এরপর আমরা তাদের দেওয়া গাইডলাইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।

১০ সেপ্টেম্বর সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে গ্লোব বায়োটেকের ডা. আসিফ মাহমুদ বলেছিলেন, ‘আমরা এর আগে প্রথম পর্যায়ের ট্রায়ালে সাফল্যের কথা আমরা গণমাধ্যমে বলেছিলাম। ওই ট্রায়ালের সাফল্যের পর আমরা দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল করছি। প্রাণীদেহের ওপর এই পর্বের ট্রায়ালও প্রায় শেষ। এখন ডেটা কালেকশন চলছে। আগামী সপ্তাহ নাগাদ ডাটা কালেকশন শেষ হতে পারে বলে আশা করছি। এই ডাটা কালেকশন শেষ হলেই সেটি বিশ্লেষণ করে আমরা আগামী সপ্তাহের শেষ নাগাদ হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য আবেদন করব বিএমআরসি’র কাছে। সেখানে অ্যানিম্যাল স্টাডির তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন শেষে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য আবেদন থাকবে। অনুমতি পেলে আমরা ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের (সিআরও) মাধ্যমে ট্রায়াল শুরু করব।’

সপ্তাহখানেকের মধ্যে তথ্য সংগ্রহ শেষ করে বিশ্লেষণের পর মানবদেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগের প্রক্রিয়া সেপ্টেম্বর মাসেই শুরু করার বিষয়ে আশাবাদী বলে জানিয়েছিলেন ডা. আসিফ।

১ অক্টোবর গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) বিভাগের প্রধান ড. আসিফ মাহমুদ সারাবাংলাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানান, তারা তাদের ভ্যাকসিনের নাম দিয়েছেন ‘ব্যানকোভিড’, যা মূলত ডি৬১৪জি ভ্যারিয়েন্টস এম-আরএনএভিত্তিক ভ্যাকসিন। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এই ঘরানার মধ্যে ‘ব্যানকোভিড’ই প্রথম ভ্যাকসিন। আর এটিই প্রাণীদেহে দ্বিতীয় ধাপে প্রয়োগ করে সাফল্য মিলেছে। কোল্ড স্প্রিং হারবার ল্যাবরেটরি পরিচালিত ‘বায়ো আর্কাইভ’ সার্ভারে তাদের এ সংক্রান্ত গবেষণা নিবন্ধ ছাপা হয়েছে।

পরবর্তীতে ৫ অক্টোবর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের উদ্ভাবিত টিকা ‘ব্যানকোভিড’ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের সিইও ড. কাকন নাগ। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত ব্যানকোভিড টিকাটি ডি৬১৪জি ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে প্রথম ও একমাত্র আবিষ্কৃত টিকা। ইতোমধ্যে অ্যানিমেল মডেল ইঁদুরে নিয়ন্ত্রিত ও পূর্ণাঙ্গ প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ব্যানকোভিড সম্পর্ণ নিরাপদ ও কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। যার বিস্তারিত ফলাফল বায়ো-আর্কাইভে (biorxiv) প্রি-প্রিন্ট আকারে প্রকাশিত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বর্তমানে কন্ট্রাক্ট রিসার্স অর্গানাইজেশনের (সিআরও) সঙ্গে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রটোকল তৈরির কাজ করছি। আশা করছি, তারা খুব শিগগিরই বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদে (বিএমআরসি) ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নৈতিক ছাড়পত্রের জন্য এই প্রটোকলসহ আবেদন করবেন। বিএমআসির নৈতিক অনুমোদন সাপেক্ষে দ্রুততম সময়ে তারা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কাছেও প্রটোকলস ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করার জন্য আবেদন করতে পারবেন।’

১৪ অক্টোবর মানবদেহে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন ‘ব্যানকোভিড’ ট্রায়ালের জন্য দেশে ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের সঙ্গে আইসিডিডিআরবি এক সমঝোতা স্মারক সই করে। ওই সময় আইসিডিডিআরবি’র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আলম জানিয়েছিলেন, গ্লোব বায়োটেকের এই টিকা তিন হাজার মানুষের ওপর ট্রায়াল দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘প্রাণীদেহে ট্রায়ালের পর্যালোচনা করবে আইসিডিআরবি। তারপর মানবদেহে ট্রায়ালের জন্য মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল বিএমআরসি ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদন চাওয়া হবে। সেটি পাওয়ার পর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হবে।’ তবে কবে নাগাদ ট্রায়াল শুরু হবে এমন প্রশ্নে নির্দিষ্ট কোনো সময় বলতে পারেনি গ্লোব বায়োটেক।

১৭ অক্টোবর দেশীয় প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের তৈরি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ‘ব্যানকোভিড’কে তালিকাভুক্ত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। প্রতিষ্ঠানটির তালিকায় গ্লোব বায়োটেকের আবিষ্কৃত তিনটি ভ্যাকসিন অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

অগ্রগতি করোনা গ্লোব বায়োটেক ব্যানকোভিড ভ্যাকসিন হিউম্যান ট্রায়াল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর