Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিশু হাসপাতালে ৩ দিনে ১২৭ নমুনায় করোনা পজিটিভ ৭১ শিশু


২৭ নভেম্বর ২০২০ ১৮:৫৫

ঢাকা: দেশে অব্যাহতভাবে বাড়ছে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ। শুরুর দিকে শিশুদের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ কম মনে করা হলেও শিশু হাসপাতালের গত কিছুদিনের তথ্য বলছে, তাদের মধ্যেও করোনা সংক্রমণ রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। এমনকি কোনো ধরনের উপসর্গ না থাকলেও পরীক্ষা করে অনেক শিশুই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত বলে জানা যাচ্ছে।

সবশেষ গত ১৮, ১৯ ও ২১ নভেম্বরের তথ্য বলছে, এই তিন দিনে মোট ১২৭টি শিশুর নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭১টি শিশুর শরীরেই করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ মোট নমুনা পরীক্ষার প্রায় ৫৬ শতাংশ শিশু ছিল আক্রান্ত। আর গত এপ্রিল থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালটিতে তিন হাজার ১৩৭টি শিশুর নমুনা পরীক্ষায় ৪১৪টি শিশুর মধ্যে এই সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এই শিশুদের প্রায় ৬৩ শতাংশ ভুগছিল অপুষ্টিতে। এদের মধ্যে মারা গেছে ১৩টি শিশু।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের বাইরে যাওয়ার সুযোগ কম। পরিবারের বড় সদস্যদের যারা বাইরে যাচ্ছেন, তাদের মাধ্যমেই হয়তো শিশুরা সংক্রমিত হচ্ছে। ফলে শিশুদের  মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিষয়টি নিয়ে সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে। তাছাড়া উপসর্গহীন শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে বলে তাদের মাধ্যমে যেন অন্যরা সংক্রমিত না হয়, সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।

শিশু হাসপাতাল সূত্র বলছে, গত ১৮ অক্টোবর এই হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত ৩৮টি নমুনা পরীক্ষা করে আট জনের মধ্যে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। পরদিন ১৯ অক্টোবরের চিত্রটি ছিল ভয়াবহ। এদিন ৩৫টি নমুনার মধ্যে ৩২টিতেই করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। আর ২১ নভেম্বর ৫৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৩১ জনের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তিন দিনের হিসাব বলছে, ১২৭টি নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৭১টি নমুনায়। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এদিকে, ১৮ ও ১৯ নভেম্বর যে ৪০টি শিশুর করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে মাত্র চার জনের শরীরে করোনা উপসর্গ ছিল।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, ১৭ এপ্রিল থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সাত মাসের তথ্য বলছে, এই হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করা ৩ হাজার ১৩৭টি নমুনার মধ্যে ৪১৪টি নমুনায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। সে হিসাবে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় প্রতি সাতটি নমুনায় একটি করোনা পজিটিভ।

করোনাভাইরাস মহামারির শুরু থেকেই এই ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সে তুলনায় নবজাতক ও শিশুদের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণের আশঙ্কা এবং তাদের ক্ষেত্রে কোভিডের প্রাণঘাতী হয়ে ওঠার আশঙ্কা খুব কম বলেই ধারণা করছিলেন তারা।

এর আগে, চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন (সিএইচআরএফ) ও শিশু হাসপাতালের এক যৌথ গবেষণাতেও শিশুদের মধ্যে করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাব দেখা গেছে। একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয় সেই গবেষণা প্রতিবেদন। রাজধানীর শিশু হাসপাতালে ২৯ মার্চ থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত যে নবজাতকরা চিকিৎসা নেওয়ার জন্য ভর্তি হয়েছিল, তাদের নমুনা পরীক্ষা নিয়ে ওই গবেষণা চালানো হয়। তাতে ৮৩টি নবজাতকের নমুনা পরীক্ষা করে ২৬টির শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়। এদের সর্বোচ্চ বয়স ছিল আট দিন।

শিশু হাসপাতালের গত সাত মাসের তথ্য এবং শিশু হাসপাতাল ও সিএইচআরএফের গবেষণার তথ্য বলছে, নবজাতক ও শিশুদের মধ্যে যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের বড় অংশই উপসর্গহীন। তারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে নবজাতকদের মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে শিশুদের মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রভাব বিশদভাবে বুঝতে হলে আরও ব্যাপক পরিসরে গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রিজওয়ানুল আহসান সারাবাংলাকে বলেন, নবজাতক ও শিশুদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্তও শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ বা শিশুমৃত্যুর হার কম পাওয়া যাচ্ছে। তবে উপসর্গ ছাড়াই যেভাবে শিশুরা সংক্রমিত হচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। তার চেয়েও বড় কথা, এই শিশুরা তো বাড়ির বাইরে যাচ্ছে না। তাহলে তারা কিভাবে সংক্রমিত হচ্ছে? বড়দের মধ্যে যারা বাইরে যাচ্ছেন, তাদের মাধ্যমেই নিশ্চয় সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। সেই বড়রাও কিন্তু স্ক্রিনিংয়ের বাইরে থাকছেন। তাদের মাধ্যমে নিশ্চয় আরও অনেকে আক্রান্ত হতে পারে। ফলে সার্বিক পরিস্থিতিতে আমাদের অনেক বেশি সচেতন থাকতে হবে।

শিশু হাসপাতালের এপিডেমিওলজিস্ট ডা. কিংকর ঘোষ সারাবাংলাকে বলেন, দেশে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির শুরু থেকেই আমরা শিশু হাসপাতালে নিরবচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এখানে ভর্তি থাকা শিশুদের পাশাপাশি বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদেরও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা নিয়ে বহির্বিভাগে আসা অধিকাংশ শিশুরই কোভিড-১৯ সম্পর্কিত কোনো উপসর্গ ছিল না। তারপরও তাদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পরে তাদের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গেছে। অর্থাৎ উপসর্গ না থাকলেও শিশুরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে।

ডা. কিংকর বলছেন, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কোভিড-১৯ উপসর্গহীন থাকছে। এটা বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আসলে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে বাচ্চাদের কোভিড-১৯ হয় না— এমন ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সবার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করাও প্রয়োজন।

সবাইকে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিষয়টিতে জোর দেওয়ার কথা বললেন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নওশাদ উদ্দিন আহমেদও। তিনি বলেন, শিশুদের কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হলে পরিবারের সবার প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা বড়রা সচেতন থাকলেই কেবল শিশুদের এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। তাছাড়া মহামারির এই সময়টিতে শিশুদের ঠিকমতো পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। কোনো ধরনের অসুস্থতা বা অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

শিশুদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের মাধ্যমেই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলে মনে করেন ডা. নজরুল কোভিড প্রতিরোধ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও ভাইরোলজিস্ট ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের দেশে অনেকেই এখন স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। মাস্ক না পরেই ঘরের বাইরে চলে যাচ্ছেন। আবার তারা যখন বাসায় ফিরছেন, শিশুরা সরাসরি তাদের সংস্পর্শে চলে আসছে। এই বিষয়গুলোর কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। সবাই যদি গা ছাড়া ভাব দেখাতেই থাকে, তাহলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা বলা মুশকিল।

উপসর্গ করোনা সংক্রমণ করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ শিশু হাসপাতাল শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর