৬৫ লাখ কোটি টাকার ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মঙ্গলবার উঠছে এনইসিতে
২৭ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৩৩
ঢাকা: ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে পরবর্তী পাঁচটি অর্থবছরে বাস্তবায়নের জন্য অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া চূড়ান্ত করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। পাঁচ বছর মেয়াদি এই পরিকল্পনায় খরচ হবে ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ (দেশীয়) উৎস থেকে খরচের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫৭ লাখ ৪৮ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা, বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে ৭ লাখ ৪৭ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।
পাঁচ বছর মেয়াদে এক কোটি ১৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৫১ শতাংশে উন্নীত করা, জিডিপির ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ বিনিয়োগ ও সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৪ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রাখা হয়েছে এই অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। এতে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১২ লাখ ৩০ হাজার ১২০ কোটি টাকা এবং ব্যক্তি খাত থেকে ৫২ লাখ ৬৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা খরচের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাটি উপস্থাপন করা হয়েছে। পরিকল্পনার সারসংক্ষেপ শুনে তিনি এতে সম্মতিও দিয়েছেন। তার সম্মতিতেই আগামী মঙ্গলবার (২৯ ডিসেম্বর) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে উপস্থাপন করা হচ্ছে এই অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। অনুমোদন পেলে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত এটি বাস্তবায়ন করবে সরকার।
মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে গণভবন থেকে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী ও এনইসি চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড.শামসুল আলম পরিকল্পনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরবেন।
জিইডি সদস্য ড. শামসুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, সরকারের উন্নয়ন রূপকল্প ও নির্বাচনি ইশতেহারের আলোকে এ পরিকল্পনার নীতি ধারাবাহিকতার দিকটিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) লক্ষ্যগুলো এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এসব লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
এনইসি’তে উপস্থাপনের জন্য তৈরি সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, দারিদ্র্যবান্ধব, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় গুণগত শিক্ষা, সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা ও কোভিড-১৯ সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট সাময়িক বেকারত্বসহ বিদেশ ফেরত কর্মীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃজনের লক্ষ্য রাখা হয়েছে। এছাড়া শ্রমবাজরে প্রবেশের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমতা নিশ্চিত করা, আয় বৈষম্য কমানো, সমন্বিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা, টেকসই নগরায়ন, সরকারের আমার গ্রাম আমার শহর প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পরিকল্পনায় ২০২৫ সাল নাগাদ কর-জিডিপির অনুপাত বর্তমানের ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ করা হবে। রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং বাণিজ্য শুল্কের ওপর নির্ভরতা কমাতে এই দুই লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজস্ব আইন আরও বেশি সংস্কারের মাধ্যমে কর প্রশাসনকে আধুনিক ও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
কী থাকছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়
গত বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সামনে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন ড. শামসুল আলম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, পাঁচ বছরের জন্য এই পরিকল্পনায় অর্থনীতি ও সামাজিক সুরক্ষার বিভিন্ন দিক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থনৈতিক দিকগুলোর মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কর্মসংস্থান বাড়ানো, জিডিপি প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি ধরে রেখে বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে কমিয়ে আনা এবং বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানোর দিকে। আমরা আশাবাদী, আগামী পাঁচটি বছরকে সামনে রেখে যেভাবে প্রাক্কলনগুলো করা হয়েছে, সেগুলো অর্জন করা সম্ভব হবে।
৫ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৮ দশমিক ৫১ শতাংশে
৮ দশমিক ৫১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৮ দশমিক ২২ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং পরিকল্পনার বাস্তবায়নের শেষে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৫১ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে।
৫ বছরে ১ কোটি ১৯ লাখ কর্মসংস্থান সৃজন
ড. শামসুল আলম বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আগামী পাঁচ বছরে নতুন এক কোটি ১৯ লাখ কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে ৮৪ লাখ ২০ হাজার এবং প্রবাসে ৩৫ লাখ কর্মসংস্থান ধরা হয়েছে। তবে কর্মসংস্থানের এই লক্ষ্য সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার তুলনায় ১০ লাখ কম।
জিইডির প্রক্ষেপণে বলা হয়েছে, আগামী ৫ বছরের মধ্যে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ২২ লাখ ৮০ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি হবে— দেশীয় ১৫ লাখ ৮০ হাজার ও প্রবাসে সাত লাখ। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ১৬ লাখ ২০ হাজার ও প্রবাসে সাত লাখ মিলিয়ে কর্মসংস্থান তৈরি হবে ২৩ লাখ ২০ হাজার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা ২৩ লাখ ৮০ হাজার— দেশীয় ১৬ লাখ ৮০ হাজার ও প্রবাসে সাত লাখ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই লক্ষ্য কিছুটা কম ২১ লাখ ২০ হাজার— দেশীয় ১৪ লাখ ২০ হাজার ও প্রবাসে সাত লাখ। আর পরিকল্পনার শেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশীয় ১৮ লাখ ১০ হাজার ও প্রবাসে সাত লাখ মিলিয়ে মোট কর্মসংস্থান ধরা হয়েছে ২৫ লাখ ১০ হাজার।
বিনিয়োগ বেড়ে হবে জিডিপি’র ৩৭%
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ বছরে বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে মোট জিডিপির ৩৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে অর্থবছরভিত্তিক লক্ষ্য হচ্ছে— চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে জিডিপির ২০ দশমিক ৮ শতাংশ, ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ, ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ, ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ, ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ ও ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ আসবে বিনিয়োগ থেকে।
৫ বছরে মূল্যস্ফীতি নামবে ৫ শতাংশের নিচে
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পাঁচ বছর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৪ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রাখা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ৫ দশমিক ২ শতাংশ, ৪ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ৪ দশমিক ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি প্রাক্কলন করা হয়েছে এই পরিকল্পনায়।
ড. শামসুল আলম বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আগের মতো কার্যকর পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এজন্য পরিকল্পনা দলিলে জাতীয় অগ্রাধিকার সামষ্টিক ও খাতভিত্তিক ১৫টি ক্ষেত্র পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের লক্ষ্যে ১০৪টি সূচক সম্বলিত একটি ফলাফলভিত্তিক পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কাঠামো সংযোজন করা হয়েছে। এই কাঠামোর ভিত্তিতে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ পরিকল্পনা দলিলের মধ্যবর্তী ও সমাপ্ত মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।
আরও পড়ুন-
- অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা: ৫ বছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৮.৫১%
- প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি, ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা উঠছে এনইসিতে
- চার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উন্নত বাংলাদেশ বাস্তবায়নের রূপরেখা
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এনইসি বৈঠক জিইডি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ