‘আকর্ষণীয় অফারে’ নানা প্রতারণা, অসচেতনাই দায়ী বলছে পুলিশ-র্যাব
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৯:৫৯
ঢাকা: বিদেশে মোটা অংকের বেতন, কিংবা দেশেই আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি অথবা বিনিয়োগ করলেই দ্বিগুণ লাভের মতো নানা অফার দেখিয়ে প্রতারণার হিড়িক চলছে দেশে। এতে শুধু সাধারণ কিংবা সহজ-সরল জনগণই যে ভুক্তভোগী তা কিন্তু নয়। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও প্রতারণার শিকার হয়ে হারিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। কিন্তু প্রতারকদের হাতে সর্বশান্ত না হওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ কিংবা প্রতিকার চাইতে আসে না কোনো ভুক্তভোগীই। যে কারণে প্রতারকদের বিরুদ্ধে কঠোর অ্যাকশন নিতে পারে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি যেভাবে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তা অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। যদিও প্রতারকদের অধিকাংশই গ্রেফতারও হচ্ছে কিন্তু ৬ মাস যেতে না যেতেই আবার জামিনে বেরিয়ে একই কাণ্ডে জড়াচ্ছে তারা। তাই প্রতারণা শিকার না হয়ে আগেই এটি প্রতিরোধে ভুক্তভোগীদের অধিক সচেতনাই নজর দেওয়ার তাগিদ তাদের। সর্বশান্ত না হওয়ার আগপর্যন্ত কোনোভাবেই ভুক্তভোগীরা প্রতিকার চাইতে আসে না। তবুও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ার এলাকার রিকশা চালক জহির উদ্দিন। গত দশ বছর ধরে রিকশা চালিয়ে তিন সন্তান নিয়ে তিনি সংসার চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু করোনাকালে সে আয়ও প্রায় বন্ধ হয়ে পড়লে ভীষণ বিপাকে পড়েন জহির। কিন্তু তার এ দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়ায় এলাকার পরিচিত একজন পোশাক কারখানার কর্মী মনির উদ্দিন। সে ঢাকায় একটি গার্মেন্টেস কারখানায় কাজ করলেও করোনাকালে কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেলে গ্রামে চলে যায়। মনির করোনাকালে জহিরের দুর্দিন দেখে বিভিন্ন জায়গা থেকে খাদ্যসামগ্রী এনে দেয়। এভাবে মনিরের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে জহিরের। একদিন মনির তাকে পরামর্শ দেয় টাকা-পয়সা যা আছে সব এক করে ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়া চলে যেতে। সেখানে রেস্টুরেন্টে চাকরি করলে মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতন পাবে। সঙ্গে বকশিসের টাকায়ও মাসে মিলবে ১০-১২ হাজার টাকা। মনিরের এমন প্রলোভনে জমানো কিছু টাকা এবং জমি বিক্রি করে আড়াই লাখ টাকা তুলে দেয় জহির।
মনিরও যাদের মাধ্যমে জহিরকে মালয়েশিয়া পাঠাবে তাদের কাছে টাকা জমা দেয়। এর মধ্যে ভিসা-পাসপোর্ট সব প্রস্তুত হয়ে যায়। একদিন জহির তার স্বপ্নের পথে পা দেওয়ার তারিখ পায়। তারিখ অনুযায়ী জহির বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে রাজধানীর মালিবাগে যাদের মাধ্যমে বিদেশ যাবে তাদের কাছে আসে। এসে দেখে জহিরের মত আরও ১৭ জনও মালেশিয়া যাবে। যথারীতি সবাই মিলে রওয়ানা হয়। কিন্তু জহিরেরা দেখল তারা যে বাসে উঠছে তা বিমানবন্দরে যায়নি। তখনি তাদের সন্দেহ হয়।
পরে জানতে পারে তারা সবাই অবৈধভাবে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কাউকে মালয়েশিয়া, কাউকে ইউরোপের আয়ারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে নেওয়া হচ্ছে। অবৈধভাবে নিচ্ছে তাই তারা বিমানে নয়, বাসযোগেই যেতে হবে। এজন্য তাদের প্রথম নেওয়া হয় ভারতের হায়দারাবাদে। সেখানে গিয়ে দেখা মিলল আর ১০ জনের। যারা জহিরদের মতই বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রতারণার শিকার হয়েছে। ততক্ষণে জহিরসহ ১৭ জনও বুঝে ফেলছে তারা প্রতারণার শিকার। তাদেরকে সেখানে ১৫-২০ দিন আটকে রেখে সবার বাড়ি থেকে আরও কয়েক লাখ টাকা নেয় প্রতারকরা। পরে তাদেরকে নৌকাযোগে শ্রীলঙ্কার জঙ্গল নিয়ে রাখে। সেখান থেকে বিভিন্ন দেশে পাচার করে দেওয়ার খবর পেয়ে তারা স্থানীয় শ্রীলঙ্কানদের সহায়তায় বাংলাদেশে ফিরে আসে।
বাংলাদেশে ফেরার পর তারা বিষয়টি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) অবহিত করে। সিআইডি অভিযোগ পেয়ে অভিযান চালিয়ে এ চক্রের ২ সদস্যকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর চক্রটির নানান প্রতারণার তথ্য পায় সিআইডি। যা এখনও তদন্তাধীন।
ভুক্তভোগী জহির সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি যার মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়েছি সে মনিরও একপ্রকার প্রতারণার শিকার। আমি পালিয়ে আসার পর যখন তাকে ধরেছিলাম তখন সে জানায়, সে যদি লোক ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে তাকে জন প্রতি ২০ হাজার টাকা করে দিবে। কিন্তু তারা যে প্রতারক তা সে জানতো না বলে দাবি করেছে। এমনকি যে ২০ হাজার টাকা তাকে দেওয়ার কথা বলেছিল তাও দেয়নি প্রতারকরা। তাই মনিরকে পুলিশ আর গ্রেফতার করেনি।’
—এতো গেল বিদেশ পাঠানোর নামে প্রতারণার ফাঁদের মাত্র একটা বাস্তবতা। শুধু চলতি বছরেই এমন অন্তত অর্ধশত অভিযোগের তদন্ত নেমেছে সিআইডি। যার কয়েকটির তদন্ত শেষে কয়েকজন প্রতারককে গ্রেফতারও করা হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তদন্তে সিআইডি জানতে পেরেছে, বিদেশে লোক পাঠানোর নামে প্রতারণায় শুধু দেশি প্রতারক নয়, বিদেশি চক্রও জড়িত রয়েছে।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশ যেতে গিয়ে অর্থ প্রতারণার শিকার এমন ভুক্তভোগীদের অভিযোগে এখন পর্যন্ত যাদেরকে গ্রেফতার করেছি তারা সবাই সুচতুর। সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বিলাসী জীবনের প্রলোভন দেখিয়েই প্রতারণা করে তারা। কিন্তু এসব প্রতারকদের কারো কারো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নামমাত্র আছে। আবার কারো শিক্ষায় নেই। কিন্তু তবুও তারা ঠিকই প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতারকরা জানে সাধারণ মানুষকে একটু প্রলোভন দেখালেই কাজ হয়ে যায়। তাই এদের থেকে বাঁচার উপায় হলো সচেতন থাকা। যখন কেউ বলছে বিদেশ নেবে তখন তার সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ খবর নেওয়া। যে দেশে নেবে সে দেশের সংশ্লিষ্ট দূতাবাস কিংবা সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে পরামর্শ করা। তবে প্রতারণার হাত থেকে বাঁচা সম্ভব। কিন্তু অনেকেই তা করছেন না। যে কারণে প্রতারণার হার বেড়েই চলেছে।’
তবে শুধু বিদেশ নেওয়ার নামে প্রতারণার হিড়িক চলছে তা কিন্তু নয়, একইভাবে প্রতারণা চলছে দেশে বিভিন্ন নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে নিয়োগ দেওয়ার ছলে। এমনি কয়েকটি চক্রের সদস্যদেরও গ্রেফতার এবং ভুক্তভোগীদের উদ্ধার করেছে র্যাব।
র্যাব সূত্র জানায়, গত দু’মাসে রাজধানী এবং এর আশপাশের বিশেষ করে সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জ থেকে প্রায় শতাধিক প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ৩ শতাধিক ভুক্তভোগী চাকরি প্রত্যাশিদের। কিন্তু যেসব প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা কিছুদিন জেলে থাকার পর নানা উপায়ে জামিন পেয়ে ফের একই কাজ করে। যার কারণে চরম বিপাকে পড়তে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
র্যাব-৪ এর অধিনায়ক ও অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত কয়েকমাসে যত আসামি ধরেছি তার মধ্যে অধিকাংশ প্রতারক। তারা বিভিন্ন নামে-বেনামে অবৈধ কোম্পানি খুলে তাতে নিয়োগ দেওয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করে। এতে চাকরিপ্রত্যাশীরা যোগাযোগ করলে টাকার বিনিময়ে আকর্ষণীয় বেতনে চাকরির নিয়োগপত্র হাতে ধরিয়ে দেয়। কিন্তু মাস পার হওয়ার আগেই তারা টাকা-পয়সা নিয়ে এলাকা ত্যাগ করে। এরপর অন্য এলাকায় এক মাসের জন্য ফের একটা রুম ভাড়া নিয়ে আবারও চাকরির বিজ্ঞাপন নিয়ে প্রতারণা শুরু করে।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় সময় এমন অভিযোগে এসব চক্রের সদস্যদেরকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু গ্রেফতার করলে কি হবে তারা কিছুদিন পর ফের জামিনে বেরিয়ে একই কাজে নামে। তাই এদেরকে প্রতিহত করতে হলে অবশ্যই জনগণকে সচেতন হতে হবে। কোথাও প্রতারণার শিকার হলে অবশ্যই আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে বিষয়টি যেমন অবহিত করতে হবে, তেমনি এসব কাজে প্রলোভিত হওয়া যাবে না। সেদিকেও নিজেদের লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ প্রতারকরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কৌশল খাটাচ্ছে।’
তবে শুধু যে গ্রামের সহজ-সরল মানুষ বিদেশে যেতে গিয়ে কিংবা আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছে তা কিন্তু নয়। অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি, সরকারি সচিব কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চৌকস কর্মকর্তাও কিন্তু প্রতারণার শিকার হচ্ছেন— শুধু অধিক লাভের আশায়। যার বেশ কয়েকটি ঘটনায় রীতিমত অবাক হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) টিম।
পিবিআই বলছে, প্রতারণার শিকার শুধু সহজ-সরল মানুষ নয়, অনেক চালাক-চতুর প্রভাবশালীরাও হচ্ছে। এর কারণ একটাই অল্প পুঁজিতে অধিক লাভের প্রলোভনে জড়িয়ে পড়া।
পিবিআই প্রধান ও ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এমন এমন প্রতারণার তথ্য আমরা পাচ্ছি যা শুনলে মাঝে মাঝে রাগও হয়, আবার হাসিও পায়। আমারই এক বন্ধু বিশেষ পুলিশ সুপার একবার ৪৮ লাখ টাকা প্রতারণা শিকার হয়েছিল। কে তাকে প্রলোভন দেখিয়ে ছিল যমুনা ফিউচার পার্কের একটা ফুড কোর্টের দোকানে বিনিয়োগ করলে তিন মাস পর দ্বিগুণ টাকা পাবে। কিন্তু ৪৮ লাখ টাকা দেওয়ার সপ্তাহখানেক পরেই লাভ তো দূরের কথা মূল টাকা নিয়েই ভেগছিল প্রতারক। কিন্তু আমার বন্ধু তো সহজ সরল নয়। সেও তো একজন কর্মকর্তা। তবু প্রতারিত হলো প্রলোভনে পড়ে। শুধু সে নয়, এমন একাধিক ব্যক্তি আছে যাদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিবও রয়েছে। যারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি এক অশিক্ষিত দিনমজুরের পাল্লায় পড়ে দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. বারী প্রায় দেড় কোটি টাকা হারিয়েছেন। একটি চক্র নাসার গবেষণা কাজে ব্যবহৃত হয় দাবি করে একটা কয়েন বিক্রি করে এ টাকা সে হাতিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু কয়েনটি ছিল কাঠের তৈরি।’
পিবিআই প্রধান বলেন, ‘প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশের সমস্যা ছিল প্রলোভনে জড়িয়ে যাওয়া। যে কারণে প্রলোভনে পড়া ব্যক্তি সর্বশান্ত না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি কাউকে জানাতে চায় না। যদি তার লাভ বন্ধ হয়ে যায় এ চিন্তায়। কিন্তু যখন তারা আমাদের জানায় তখন আমাদের আসামিকে গ্রেফতার করা ছাড়া তেমন কিছু করারও থাকে না। কারণ অনেক সময় দেখা যায়- প্রতারক যে টাকা প্রতারণা করেছে তা আর উদ্ধার করা যায় না। তাই আমাদের আহ্বান থাকবে কোনোভাবেই প্রলোভনে পড়া যাবে না। যখনি দেখবেন কোথাও প্রচলিত নিয়মের চেয়েও অধিক লাভ দিচ্ছে তখন বুঝে নিবেন, এখানে প্রতারণা হচ্ছে।’
সারাবাংলা/এসএইচ/এমও