‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’
৭ মার্চ ২০২১ ১৬:৪৯
চল্লিশের দশকে প্রখ্যাত মনীষী এস. ওয়াজেদ আলি এমন একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন; বলেছিলেন, ‘এই জাতি একজন মহামানবের প্রতীক্ষায় আছে।’ কী গভীর অর্থবহ কথা। আশাটা কি বেশি করা হয়েছিল যে, ‘বাঙালি শুধু ভারতবর্ষের নয়, প্রাচ্য ভূখণ্ডের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর প্রদর্শক হবে?’ অথচ কী আশ্চর্য, চল্লিশের দশক থেকে ষাটের দশক- মাত্র দু-দশক সময়ের ব্যবধানে এমন একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির প্রতি তাঁর আবেগ ছিল সীমাহীন, বাঙালিকে কেন্দ্র করে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল মৃত্তিকাসংলগ্ন এবং সমুদ্রসমান ভালোবাসা দিয়ে এ জাতিকে গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেবার তিনি একটি স্বপ্ন তৈরি করেছিলেন নিজের সবটুকু দিয়ে। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, ভাষাগত ও জাতিগত একটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হলে তা এ সময়ের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হবে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে যদি অনেক রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তাহলে আর কোনো বৃহৎ শক্তি থাকবে না। কেউ কারো ওপর কর্তৃত্ব করতে পারবে না। শান্তি ও কল্যাণের রাষ্ট্র হবে সেগুলো। আগামী দিনের ছেলেমেয়েরা জানবে না বিশ্বযুদ্ধ কী। বাংলাদেশের মতো একটি একটি করে গড়ে উঠবে হাজারো রাষ্ট্র।
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ তাঁর সেই অসাধারণ ভাষণে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, একটি অলৌকিক বাক্য। তিনি তর্জনী তুলে পরিষ্কার বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ বাক্যটি নিয়ে ভেবে দেখতে হবে। তিনি যদি প্রমিত বাংলা ব্যবহার করতেন তাহলে বলতেন, ‘সাত কোটি মানুষকে আর দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ তিনি প্রমিত বাংলা ব্যবহার করেননি। আঞ্চলিক শব্দ সহযোগে আঞ্চলিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করে মুহূর্তের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তার হৃদয়ের বিশাল এক দরোজা খুলে দিয়েছেন, যে দরোজা পথে বেরিয়ে এসেছে বাঙালি চরিত্রের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য।
এই ছোট্ট বাক্যটি সেতুবন্ধ গড়ে তুলেছে এস. ওয়াজেদ আলির দীর্ঘ বাক্যের সঙ্গে; যেখানে তিনি বলেছেন, ‘বাঙালি এখন সেই মহামানবের প্রতীক্ষায় আছে। যিনি তাদের এই গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেবেন- ভগীরথের মতো এই বাংলায় ভাবগঙ্গার সঙ্গম সুস্পষ্ট করে তুলবেন।’ পার্থক্য এই যে, তাঁকে দীর্ঘ অর্থবহ বাক্য রচনা করতে হয়নি। তিনি রচনা করেছেন ছোট অথচ তীক্ষ্ণ; অপ্রমিত অথচ গভীর অর্থবহ বাক্য। একজন প্রাজ্ঞ সাহিত্যে, আর একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিতে। দুজনেরই অঙ্গীকার জাতির কাছে, জীবনে কাছে। দুজনেরই যাত্রা অসীম জীবনের সন্ধানে। দুজন দুই পথের অথচ একজন আরেকজনের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। দুজনের অজান্তে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের অলিখিত সত্য। একজন সাহিত্যের ভিতর দিয়ে রাজনীতির কথা বলেছেন, অন্যজন রাজনীতির ভিতর দিয়ে সাহিত্যের কথা বলেছেন। দুটোই জীবন-সম্পৃক্ত, মানুষ সম্পৃক্ত।
৭ই মার্চের ভাষণে সেদিন তিনি সেই বাক্যটির পরে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ লক্ষণীয় বিষয় যে, এই বাক্যটি তিনি প্রমিত বাংলায় বলেছেন। এখানেও এস. ওয়াজেদ আলির ওই বাক্যের সঙ্গে সংযোগ-সেতু রচিত হয়। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘এখন বাঙালি কেবল ভারতবর্ষের নয়, কেবল প্রাচ্য ভূখণ্ডের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক হবে।’ কী আশ্চর্যভাবে তিনি জাতীয় পটভূমি থেকে আন্তর্জাতিক মাত্রায় উন্নীত হয়েছেন।
মুক্তির সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম প্রতিটি দেশের জন্য সার্বজনীন সত্য। মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম এককভাবে হয় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় আন্তর্জাতিক সমর্থন, সাহায্য এবং সহযোগিতা। তাই বাক্যটি উচ্চারিত হয় প্রমিত বাংলায়। বাঙালি জাতিসত্তার ঊর্ধ্বে পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে মেলবন্ধনের প্রত্যাশায়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভগীরথের মতো এই বাংলায় ভাবগঙ্গার সঙ্গম। সেদিনের বক্তৃতায় তাঁর উত্থিত সেই অমিতবিক্রম তর্জনীর সঙ্গে কণ্ঠস্বর যখন একই সমান্তরালে পৌঁছে যায়, তখনই বাঙালির অভিনব জীবন আস্বাদের স্পৃহা প্রবল হয়ে ওঠে।
‘সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’- এই পঙ্ক্তিটির চিত্রকল্প কল্পনা করলে কেমন দাঁড়াবে? ধরে নেওয়া যায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটি জনগোষ্ঠী। তার ঘাড়ের ওপর শোষকের পা, নিংড়ে নিতে চায় তার জীবনের নির্যাস। কিন্তু কতোদিন পা দাবিয়ে রাখবে? একে-দুয়ে মাথা ওঠাতে থাকে। সেই পা অস্বীকার করে উঁচু হয়ে উঠতে চায় মাথা। ঘাড় উঁচু করে তাকাতে শুরু করে আকাশের দিকে। শাসকের দুই পা দুই হাতে ধরে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। ভেবে নেওয়া যায় যে, এমন অজস্র উঁচু হয়ে ওঠা মাথার চিত্রকল্প নিয়েই রচিত হয়েছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বল বীর চির উন্নত মম শির’- কী আশ্চর্য মেলবন্ধন! এভাবেই বুঝি কবিতার ভাষার সঙ্গে রাজনীতির ভাষা এক হয় যায়। মুখোমুখি দাঁড়ায় কবি ও রাজনীতিবিদ। ‘সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’ পঙ্ক্তিটি এভাবেই কালজয়ী হয়ে ওঠে।
ইতিহাসে তিনিই অমর, যিনি সমগ্র জাতিকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন। ইতিহাস তাঁরই পক্ষে, যিনি সময়ের বিচারে নিজেকে যোগ্য বলে প্রমাণ করতে পারেন। এ সংজ্ঞার্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের সেই মহামানব, সময় যাঁকে সৃষ্টি করেনি, যিনি সময়কে নিজের করতলে নিয়ে এসেছেন। যিনি কঠোর স্বরে স্বকীয় ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেছিলেন সব কালের উপযোগী এবং সব দেশের জন্য প্রযোজ্য অমর পঙ্ক্তি- ‘সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’।
এই কথাকে মনে রেখেই ভারতের উর্দু ভাষার বিখ্যাত কবি কাইফি আজমি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লিখেছিলেন ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক কবিতা:
‘শুধুতো একটি দেশ নই যে জ্বালিয়ে দেবে
প্রাচীর নই যে তা পুরোপুরি মুছে ফেলবে
……………………………………….
কতই না নির্বোধ তুমি
খয়রাতে পাওয়া ট্যাংক নিয়ে আমার দিকে ধেয়ে আসছ
রাত দিন নাপাম বোমার বৃষ্টি বর্ষাচ্ছে
ক্লান্ত হয়ে পড়বে দেখো
শৃঙ্খল পরাবে তুমি কোন হাতে
হাততো আমার আছে সাত কোটি
গর্দান থেকে কোন মাথাটি তুমি আলাদা করবে
সেখানেতো মাথা আছে সাত কোটি।
[বি.দ্র.: লেখাটি সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ কর্তৃক ২০১৭ সালের মার্চে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ: রাজনীতির মহাকাব্য’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া। পরবর্তী সময়ে গ্রন্থটির গ্রন্থস্বত্ব চলে যায় বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে। ফলে লেখাটি প্রকাশের আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর ও বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এবং সম্পাদকের কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নেওয়া হয়েছে।]
সারাবাংলা/পিটিএম
৭ই মার্চের ভাষণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেলিনা হোসেন