ডিএনএ পরীক্ষায় কেবল দিহানের উপস্থিতি, আনুশকার পরিবার মানতে নারাজ
২১ এপ্রিল ২০২১ ২১:৫৮
ঢাকা: রাজধানীর কলাবাগানে বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ও-লেভেল শিক্ষার্থী আনুশকা নুর আমিনের মরদেহের ডিএনএ (ডি-অক্সি রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) পরীক্ষা করা হয়েছে। এরই মধ্যে সেই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে প্রতিবেদনও তৈরি করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সেই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে কলাবাগান থানা পুলিশের হাতে। প্রতিবেদনে আনুশকার সঙ্গে কেবল দিহানেরই শারীরিক সম্পর্কে প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে, আনুশকার পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল, দিহানের সঙ্গে তার বন্ধুরাও সেদিন উপস্থিত ছিল দিহানের বাসায়। তারা সবাই মিলেই আনুশকাকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ ছিল তাদের। কিন্তু প্রতিবেদনে ঘটনাটির সঙ্গে কেবল দিহানের জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করায় হতাশা প্রকাশ করেছেন আনুশকার বাবা। প্রতিবেদনটিকে মিথ্যা অভিহিত করে এটি প্রত্যাখ্যান করবেন বলে জানান তিনি।
বুধবার (২১ এপ্রিল) আনুশকার পরিবার, কলাবাগান থানা পুলিশ, সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, সিআইডির ফরেনসিক ল্যাব থেকে আনুশকার ডিএনএ প্রতিবেদন প্রস্তুত করে কয়েকদিন আগে কলাবাগান থানা পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই স্কুলছাত্রী আনুশকার মৃত্যু হয়। আর আনুশকার সঙ্গে একমাত্র দিহানের শারীরিক সম্পর্কের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে তাই কেবল তার নামই উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই এখন কলাবাগান থানা পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে আদালতে জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আরও পড়ুন-
- দুলাল গিয়ে দেখে সোফায় শোয়ানো আনুশকা
- আনুশকাকে ধর্ষণের পর হত্যা: দিহানের দোষ স্বীকার
- আনুশকাকে ধর্ষণ পূর্বপরিকল্পিত— জিজ্ঞাসাবাদে দিহান
- মাস্টারমাইন্ড শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর হত্যা, ৪ সহপাঠী আটক
- ‘আনুশকা ধর্ষণের শিকার কি না, জানা যাবে ফরেনসিক পরীক্ষায়’
- আনুশকার বয়স বাড়িয়ে দিহানের শাস্তি কমানোর ‘অপতৎপরতা’!
- বিকৃত যৌনাচারের শিকার ছিলেন আনুশকা, রক্তক্ষরণে মৃত্যু: ফরেনসিক
ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্টের ভিত্তিতে সিআইডি সূত্র বলছে, ঘটনার দিন আনুশকার সঙ্গে দিহান ছাড়া আর আরও শারীরিক সম্পর্কের আলামত মেলেনি। তাদের দু’জনের সম্মতির ভিত্তিতেই সম্পর্ক হয়েছিল, এমনটিই বলছে প্রতিবেদন। আর তাতে ‘বাহ্যিক বস্তু’ ব্যবহারের তথ্যও পাওয়া গেছে। সেই বস্তুর আঘাতেই আনুশকার শরীরে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয় এবং সেটি তার তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সিআইডি কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি (ফরেনসিক) মো. সাহাদাত হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, আনুশকার মৃত্যুর ঘটনায় ডিএনএ প্রতিবেদন তৈরি করে কয়েকদিন আগেই মামলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে কী আছে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ সুপার (ফরেনসিক) রুমানা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি করে কয়েকদিন আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জমা দিয়েছি। ডিএনএ প্রতিবেদনে আনুশকার শরীরে দিহান ছাড়া অন্য কারও উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।’
এদিকে, আনুশকার মৃত্যুর তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ। আর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিতে পারছে না পুলিশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান মো. মাকসুদ বলেন, ‘মৃতের বয়স নির্ধারণসহ অন্যান্য প্রতিবেদন তৈরি আছে। সিআইডি ল্যাব থেকে ভিসেরা প্রতিবেদনও হাতে এসেছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পুলিশের কাছে জমা দেওয়া হবে।’
আনুশকার মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবার প্রথম থেকেই দাবি করে আসছিল ‘ধর্ষণ ও হত্যা’র সঙ্গে দিহান ও তার বন্ধুরা জড়িত। সিআইডির প্রতিবেদনে দিহান ছাড়া অন্য কারও উপস্থিতির আলামত না পাওয়ায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, দিহানের একার উপস্থিতি দেখিয়ে আনুশকার সম্মতিতে সম্পর্ক হয়েছে উল্লেখ করে হয়তো দিহানকে বাঁচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সে কারণেই এভাবে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
আনুশকার বাবা সারাবাংলাকে বলেন, ‘মামলার শুরুতে দ্রুত সব কিছু হচ্ছিল। সবার সাহায্যও পাচ্ছিলাম। তবে ধীরে ধীরে মামলার তদন্তের গতি কমে যায়। ডিএনএ প্রতিবেদনের নামে দুই মাস সময় চলে যায়। তখনই বুঝেছি, ছেলেটাকে বাঁচিয়ে দেওয়ার আয়োজন হচ্ছে। আমি এই প্রতিবেদন বিশ্বাস করি না। আমরা এই মামলার তদন্ত নিয়ে হতাশ।’
জানতে চাইলে কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরিতোষ চন্দ্র সারাবাংলাকে বলেন, ‘আনুশকার মরদেহের ডিএনএ প্রতিবেদন আমাদের হাতে এসেছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এখনো আমাদের হাতে আসেনি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে এলে অভিযোগপত্র তৈরির কাজ শুরু হবে। এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পেয়েছি, সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। যাচাই-বাছাই শেষে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করে আদালতে জমা দেওয়া হবে।’
গত ৭ জানুয়ারি দুপুরে ধানমন্ডিতে আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আনুশকার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই সময় সেখান থেকে দিহানসহ তার তিন বন্ধুকে আটক করা হয়। পরে আনুশকার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতেই আনুশকার বাবা বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় মামলা করেন।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ওই দিন দুপুর পৌনে ১২টার দিকে আনুশকা তার মাকে ফোন করে কোচিং থেকে কিছু পেপার আনার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়। অন্যদিকে দুপুর সেয়া ১টার দিকে দিহান ফোন করে আনুশকার মা’কে জানায়, আনুশকা তার বাসায় গিয়েছিল। হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ায় তাকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। দুপুর ২টার দিকে আনুশকার মা হাসপাতালে পৌঁছান। হাসপাতালের কর্মচারীদের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, দিহান তার মেয়েকে কলাবাগান ডলফিন গলির বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে।
এদিকে, গ্রেফতারের পর পুলিশের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে দিহান স্বীকার করেন, আনুশকাকে ধর্ষণ করার পরিকল্পনা থেকেই তিনি তাকে কলাবাগানের ওই বাসায় ডেকেছিলেন। পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি বলেন, শারীরিক সম্পর্কের একপর্যায়ে রক্তক্ষরণ শুরু হলে আনুশকার মৃত্যু হয়।
দিহানের এই দাবিকে নাকচ করে আনুশকার পরিবার বরাবরই বলে আসছে, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে আনুশকাকে। আর এই কাজে দিহানের সঙ্গে তার তিন বন্ধু জড়িত ছিল।
সারাবাংলা/ইউজে/টিআর
আনুশকা নুর আমিন আনুশকা হত্যা ডিএনএ টেস্ট দিহান ধর্ষণের পর হত্যা