গভীর রাতে তড়িঘড়ি করে হেফাজতের আহ্বায়ক কমিটি
২৬ এপ্রিল ২০২১ ১১:০৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার পর গভীর রাতে তড়িঘড়ি করে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছে হেফাজতে ইসলাম। কমিটিতে সদ্য বিদায়ী আমীর জুনায়েদ বাবুনগরী ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নুরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে রাখা হয়েছে।
রোববার (২৫ এপ্রিল) রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাবুনগরীর ব্যক্তিগত সহকারী ইনআমুল হাসান ফারুকী গণমাধ্যম কর্মীদের হোয়াটস অ্যাপে ম্যাসেজ পাঠিয়ে তিন সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠনের কথা জানান। পরে একই তথ্য ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’র ফেসবুক পেজে প্রচার করা হয়। নুরুল ইসলামও ভিডিও বার্তায় পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠনের কথা জানান। তবে এ সংক্রান্ত কোনো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়নি। ফলে এই আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
‘চলমান অস্থির ও নাজুক পরিস্থিতি বিবেচনায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ও মহানগর কমিটি বিলুপ্তি ঘোষণা করে পরবর্তী উপদেষ্টা কমিটির পরামর্শে ক্রমে তিন সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হলো।‘ – এমন বার্তা দেওয়া হয় হেফাজতে ইসলামের ফেসবুক পেজে। তবে চলমান ‘অস্থির ও নাজুক’ পরিস্থিতির বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন: হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত
কমিটিতে থাকা পাঁচজন হলেন- জুনায়েদ বাবুনগরী, মহিববুল্লাহ বাবুনগরী, নুরুল ইসলাম জিহাদী, সালাউদ্দিন নানুপুরী ও মিজানুর রহমান চৌধুরী। এদের মধ্যে মহিবুল্লাহ বাবুনগরী জুনায়েদ বাবুনগরীর মামা।
আহ্বায়ক কমিটি বলা হলেও হেফাজতের প্রচারিত বার্তায় জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির, মহিবুল্লাহ বাবুনগরীকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং নুরুল ইসলামকে মহাসচিব ও বাকি দুইজনকে সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে নুরুল ইসলাম ভিডিও বার্তায় নিজেকে সদস্য সচিব বা মহাসচিব হিসেবে উল্লেখ করেন।
আহ্বায়ক কমিটিতে আমির-মহাসচিব পদের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চেয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি বাবুনগরীর ব্যক্তিগত সহকারী ও হেফাজতের আমিরের সাবেক প্রেস সচিব ইনআমুল হাসান ফারুকীর কাছ থেকে।
রোববার রাত ১১টার দিকে ফেসবুকে দেওয়া ভিডিও বার্তার মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা দেন আমীর জুনায়েদ বাবুনগরী। এর সাড়ে চার ঘণ্টা পর রাত সাড়ে তিনটার দিকে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের বিষয়টি প্রচার করা হয়।
তবে বাবুনগরীর বিরোধী হিসেবে পরিচিত প্রয়াত আহমদ শফীপন্থী হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাইনুদ্দিন রুহী রাত ১২টার দিকে ফেসবুক লাইভে এসে শফীর অনুসারীদের নিয়ে নতুন করে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। মূলত এই ঘোষণার পর শফীপন্থীদের কমিটি ঠেকাতে বাবুনগরী তড়িঘড়ি করে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন বলে সংশ্লিষ্ট মহলে আলোচনা আছে।
বাংলাদেশের প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে ২০১০ সালে হেফাজতে ইসলামের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সূচনালগ্ন থেকে শফী সংগঠনটির আমির এবং জুনায়েদ বাবুনগরী মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
২০১৩ সালে যুদ্ধারপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলনকারীদের নাস্তিক-মুরতাদ আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে সরব হয় হেফাজত। একপর্যায়ে ১৩ দফা নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। ওই বছরের ৫ মে সারাদেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি পালন করে। ঢাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মধ্য দিয়ে সংগঠনটি সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। গ্রেফতার হন বাবুনগরী। পরে ছাড়া পেলেও তখন থেকেই তিনি প্রচণ্ডভাবে আওয়ামী লীগ ও সরকার বিরোধী ভূমিকা নেন।
তবে প্রবীণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মহলে শাহ আহমদ শফীর গ্রহণযোগ্যতা ছিল। একপর্যায়ে শফীর সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন মহলের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। কওমি মাদরাসার ডিগ্রির সরকারি স্বীকৃতিও আসে। এভাবে শফীর নেতৃত্বে হেফাজতের একটি অংশ সরকারের বিরোধিতা থেকে সরে আসে। কিন্তু বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন অংশ তীব্রভাবে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী এবং জামায়াতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি পায়।
এ নিয়ে ২০২০ সালে হেফাজতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। এমনকি ওই বছরের সেপ্টেম্বরে হাটহাজারী মাদরাসার অভ্যন্তরে শফীর বিরুদ্ধে সহিংস ছাত্র বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভের মধ্যেই ১৮ সেপ্টেম্বর অসুস্থ হয়ে প্রায় শতবর্ষী শফী মারা যান। তার পরিবারের পক্ষ থেকে আদালতে মামলা দায়ের হয়। এতে শফীকে মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন সম্প্রতি তদন্ত করে বাবুনগরীসহ ৪২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
এদিকে শফীর মৃত্যুর পর গত বছরের ১৫ নভেম্বর হাটহাজারী মাদরাসায় প্রতিনিধি সম্মেলনের মাধ্যমে ১৫১ সদস্যের হেফাজতের নতুন কমিটি হয়। এতে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির ও নূর হোসাইন কাসেমীকে মহাসচিব করা হয়। কাসেমী মারা যাবার পর সিনিয়র নায়েবে আমীর নুরুল ইসলামকে মহাসচিব করা হয়।
এই কমিটিতে থাকা হেফাজত নেতারা শুরু থেকেই বিভিন্ন ধর্মীয় সভায়, ওয়াজ মাহফিলে সরকার, মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিতে থাকেন।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্নস্থানে পুলিশের সঙ্গে হেফাজতের নেতাকর্মীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। দেশজুড়ে তাণ্ডবে জড়ান হেফাজতের নেতাকর্মীরা। এতে অন্তঃত ১৭ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে গণমাধ্যমে। দেশের বিভিন্নস্থানে সহিংসতায় হতাহত, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় তাণ্ডবের পর হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ বেশ কয়েকজন নেতা ইতোমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছেন।
গ্রেফতারের আগে গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে কথিত স্ত্রীসহ অবকাশ যাপনে গিয়ে স্থানীয় জনতার হাতে অবরুদ্ধ হন মামুনুল হক। এ নিয়েও বিতর্কের মুখে পড়ে হেফাজত। এ প্রেক্ষিতে বাবুনগরী বারবার গণমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে হেফাজতে ইসলাম সরকারবিরোধী নয় বলে প্রচার করেন। কয়েকদিন আগে হেফাজত নেতাদের একটি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে দেখাও করেন। তবে হেফাজতের বিরুদ্ধে সরকারের অনড় অবস্থানের আভাস মিলেছে একের পর এক নেতাদের গ্রেফতার এবং মন্ত্রীদের কয়েজনের বক্তব্য-বিবৃতিতে।
সারাবাংলা/আরডি/এএম