ফেসবুকে টিকেটের বিজ্ঞাপন দিয়ে রাতের অন্ধকারে চলছে দূরপাল্লার বাস
৫ মে ২০২১ ১৩:৪০
ঢাকা: ‘ঢাকা টু চট্টগ্রাম/কক্সবাজার যেতে চাইলে প্লিজ কল- ০১৯১৪……’, ‘এসি বাস সায়েদাবাদ থেকে রাত ৯টা এবং ৯টা ৩০ মিনিটে।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্রাউজ করতে করতে হঠাৎ এমন পোস্টে চোখ আটকে গেল। পোস্টের তথ্য অনুযায়ী ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পথে ছেড়ে যাচ্ছে রীতিমতো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস। অথচ গত ১৪ এপ্রিল থেকেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন! ফেসবুক পোস্টে তাহলে কিসের বিজ্ঞাপন?
ফেসবুক পোস্টের ওই বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরে কিছুটা খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেল, হ্যাঁ, ১৪ এপ্রিল থেকেই বন্ধ রয়েছে দূরপাল্লার সব ধরনের গণপরিবহন। কেবল পণ্যবাহী যানবাহন আর ব্যক্তিগত পরিবহনই চালু রয়েছে। তবে এই নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করছেন না অনেকেই। দিনের আলোতে মানলেও রাতের অন্ধকারে বিধিনিষেধকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কিছুটা গোপনীয়তার মধ্যে দিয়ে হলেও চলছে দূরপাল্লার বেশকিছু বাস। প্রতিদিনই ঢাকা থেকে বাস ছেড়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের পথে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে টিকেট। আর চোখের সামনে এসব দেখেও নির্বিকার প্রশাসন।
সোমবার (৩ মে) ওই ফেসবুক পোস্টের সূত্র ধরে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট করে টিকিট বিক্রি করছে শ্যামলী পরিবহন। ১৬০০ টাকা থেকে ১৮০০ টাকার টিকিটে যাত্রী নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকা থেকে কক্সবাজার। যদিও শ্যামলী পরিবহন কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের কোনো গাড়ি রাস্তায় বের হচ্ছে না।
রাজধানীর আরামবাগে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যাত্রীদের একত্রিত করে ছোট গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গোলাপবাগ। সেখান থেকেই ছাড়ছে দূরপাল্লার বাস। সেখানে চারপাশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য থাকলেও তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। চোখের সামনে ঘটনা ঘটলেও তারা যেন কিছুই দেখছেন না।
অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ফেসবুকে টিকেট বুকিংয়ের জন্য দেওয়া মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করলে কল রিসিভ করেন রবিন নামে এক ব্যক্তি। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, মঙ্গলবার (৪ মে) কক্সবাজার যাওয়া সম্ভব হবে কি না। বিজনেস ক্লাস নাকি ইকোনমি ক্লাসের গাড়ি পাওয়া যাবে, জানতে চাই সে তথ্যও। উত্তরে রবিন জানান, দুই ধরনের গাড়িই আছে। একটি গাড়ি রাত ৯টায় গোলাপবাগ থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। আরেকটি গাড়ি সাড়ে ৯টায় রওনা দেবে চট্টগ্রামের উদ্দেশে।
নিষেধাজ্ঞার মধ্যে এভাবে গাড়ি চালালে পথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটকে দেবে না তো— এমন সংশয়ের কথা জানালে রবিন বলেন, ‘আমাদের অনুমতি নেওয়া আছে। আপনি যাবেন কি না কনফার্ম করেন।’ রবিনের কাছে জানতে চাই গাড়ি কোন পরিববনের। তিনি জানান, এটি শ্যামলী পরিবহনের গাড়ি।
এরপর রাত ৮টা ৩০ মিনিটে গোলাপবাগ গিয়ে রবিনকে ফোন দিলে তিনি জানান, এক হাজার ৬০০ টাকার যে সিট ছিল, সেটি এখন আর নেই। যেতে হলে বিজনেস ক্লাসে এক হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে যেতে হবে জনপ্রতি। পাশের সিটে কোনো যাত্রী বসবে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, বসবেন।
রবিনের পরামর্শ মতো আরামবাগ শ্যামলী কাউন্টারে গিয়ে দেখা যায়, শ্যামলী পরিবহন ও সেন্টমার্টিন পরিবহনের কাউন্টারের একাংশ খোলা। সামনে দাঁড়ানো দুইটি মাইক্রোবাস। সামনে যাত্রী দেখা গেলেও কাউন্টারের ভেতরে কাউকে দেখা যায়নি। ঠিক তার উল্টো দিকে নটরডেম কলেজের সামনেই পুলিশের চেক পোস্ট।
কাউন্টারের সামনে বাস না দেখে আবারও রবিনকে ফোন দিলে তিনি জানান, পুলিশের জন্য গাড়ি রাস্তায় রাখতে পারেন না তারা। দুইটি ‘ছোট গাড়ি’তে (মাইক্রোবাস) করে যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হবে সায়েদাবাদে। সেখান থেকে বাস ছেড়ে যাবে কক্সবাজারের উদ্দেশে। রবিনের পরামর্শ অনুযায়ী সেখানে শাহিন নামে একজনের সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়। তিনিও জানান, কাউন্টারের সামনে গেলেই মাইক্রোবাসে করে যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হবে।
পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রতিবেদক যোগাযোগ করেন আরামবাগ কাউন্টারে। সেখানে থাকা আনন্দবাবু নামে এক ব্যক্তি বলেন, রবিন তাদের ফকিরারপুল কাউন্টারে কাজ করেন। আর শাহিন ‘সেঁজুতি পরিবহনে’ কাজ করেন। তবে তাদের কোনো গাড়ি রাতে চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার যাচ্ছে না।
আনন্দবাবু বলেন, একটা গাড়ি আমাদের আছে, যেটা বিমানবন্দর থেকে আসে। সেখানে সিট ফাঁকা থাকলে যেতে পারেন। তবে সেন্টমার্টিন পরিবহনের গাড়ি যাচ্ছে আজ। সেঁজুতি পরিবহনের গাড়িও যাচ্ছে।
এ বিষয়ে ফকিরারপুল শ্যামলী পরিবহন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও কেউ ফোন ধরেননি। সেন্টমার্টিন পরিবহন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তারাও কেউ কল রিসিভ করেননি।
সেঁজুতি পরিবহনের শাহিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘রাত ১১টায় আমাদের গাড়ি ছাড়বে। আপনি যেতে চাইলে দ্রুত আরামবাগ চলে আসেন।’
আন্তঃজেলা যান চলাচল বন্ধ তবুও টিকিট কিভাবে বিক্রি হচ্ছে? কাউন্টার কেন খোলা? এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, এ বিষয়ে আমার জানা নেই। নির্দেশনা অনুযায়ী আন্তঃজেলা যান চলাচল বন্ধ আছে। তারপরেও যদি গাড়ি চলে, সে বিষয়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা সিদ্ধান্ত ব্যবস্থা নেবে।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার ইফতেখারুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, বিভিন্ন বেসরকারি শিল্পকারখানা বা প্রতিষ্ঠানের যেসব কর্মকর্তা ঢাকার বাইরে থাকেন, তাদের আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে কখনো কখনো বাসের এন্ট্রি হতে পারে ঢাকায়। এছাড়াও ‘জরুরি ধান কাটার শ্রমিক’ স্টিকার ব্যবহার করে কৃষকদের বাসে করে আনা-নেওয়া করা হতে পারে। এর বাইরে কোনো যাত্রীবাহী বাস চলার কথা নয়। এ বিষয়টি আমাদের জায়গা থেকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে।
এর আগে সরকারি বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে ঝুঁকি নিয়ে চলতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একটি স্পিডবোটি। ওই ঘটনায় প্রাণ হারান ২৬ জন। এসব বিষয় নিয়ে বুধবার (৫ মে) নিজ বাসভবন থেকে দলের এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, লকডাউনে অনেকেই চোরাইপথে আসা-যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন। সম্প্রতি পদ্মায় স্পিডবোট ডুবিতে ২৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সরকারকে ফাঁকি দেওয়া যায়, কিন্তু মৃত্যুকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। এ ধরনের ঝুঁকি নিলে উৎসবের আগেই মৃত্যুর ট্র্যাজেডি অনিবার্য হয়ে পড়ে।
সারাবাংলা/এসবি/এএম/টিআর