এমপি লিটন হত্যা: ২ বছরেও হয়নি ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি
৩০ জুন ২০২১ ০৯:০০
ঢাকা: গাইবান্ধার-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামির ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি প্রায় দুই বছর ধরে হাইকোর্টে আটকে আছে। শুনানি না হওয়ায় মামলাটি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হচ্ছে না।
আলোচিত এই হত্যা মামলার রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছে লিটনের পরিবার। আর হাইকোর্টে মামলাটি দ্রুত শুনানির জন্য উদ্যোগ নেওয়ার দাবি আসামিপক্ষের। অন্যদিকে হাইকোর্টের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে হাইকোর্টে দীর্ঘদিন ডেথ রেফারেন্স শুনানি বন্ধ ছিল। এখন আবার শুনানি শুরু হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্যে কার্যতালিকায় আসবে।
২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জ সর্বানন্দ ইউনিয়নের মাস্টারপাড়ার নিজ বাড়িতে গুলিতে খুন হন মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। দুই মোটরসাইকেলে করে আসা দুর্বৃত্তরা গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। হত্যার ঘটনার পরদিন ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি অজ্ঞাত পাঁচ-ছয়জনের বিরুদ্ধে সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা করেন লিটনের ছোট বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকুলী। তদন্ত শেষে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডা. আবদুল কাদের খানসহ আটজনের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের দীর্ঘ ১৮ মাস যুক্তিতর্কের পর ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর গাইবান্ধা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক দিলীপ কুমার ভৌমিক হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে সাত আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার সময় ছয়জন আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। পলাতক ছিলেন এক আসামি। চার্জশিটে অভিযুক্ত আট আসামির মধ্যে একজন মামলা চলাকালে মারা গেছেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডা. আবদুল কাদের খান, তার পিএস শামছুজ্জোহা, গাড়িচালক হান্নান, ভাতিজা মেহেদী হাসান, দূর সম্পর্কের ভাগ্নে শাহীন মিয়া, সাবেক পোশাক শ্রমিক আনোয়ার ইসলাম রানা। পলাতক রয়েছেন আসামি চন্দন কুমার রায়। অভিযুক্ত আট আসামির মধ্যে কসাই সুবল কারাগারে অসুস্থ অবস্থায় মারা যান।
এর আগে ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার বাসা থেকে কাদের খানকে গ্রেফতার করা হয়। তখন থেকেই তিনি গাইবান্ধা জেলা কারাগারে রয়েছেন।
এ হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ দুটি মামলা করে। একটি অস্ত্র মামলা ও অপরটি হত্যা মামলা। ইতোমধ্যে অস্ত্র মামলার রায়ে একমাত্র আসামি ডা. কাদেরকে গত ১২ জুন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। দণ্ডিত কাদের খান ২০০৮ সালে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপরহাটি ইউনিয়নের পশ্চিম ছাপরহাটি (খানপাড়া) গ্রামের বাসিন্দা।
প্রথমদিকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ভেবে সন্দেহ করা হয় লিটনের স্ত্রীকে। কিন্তু পরবর্তীতে হত্যার মোড় ঘুরে যায় অন্যদিকে। একই উপজেলার ধোপাডাঙ্গায় একটি ছিনতাইয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে লিটন হত্যার রহস্য উন্মোচন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছিনতাইয়ের ওই ঘটনায় গ্রেফতার আসামিদের স্বীকারোক্তিতে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কাদের খানের সম্পৃক্ততা পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে কয়েক দিন তাকে নজরদারিতে রাখা হয়। এরপর ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বগুড়া শহরের কাদের খানের স্ত্রীর মালিকানাধীন গরীব শাহ ক্লিনিক থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।
পরে হত্যা মামলায় ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল প্রথম দফায় আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। বাদী লিটনের ছোট বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকুলী, নিহতের স্ত্রী ও তদন্ত কর্মকর্তাসহ সর্বশেষ ৫৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। পরে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম শেষ হয়।
এই মামলায় আসামি কাদের এবং পলাতক চন্দন কুমার রায় ছাড়া অন্য পাঁচজন এ হত্যাকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততা থাকার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পরে ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালতের বিচারক।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) ছিলেন শফিকুল ইসলাম শফিক। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এমপি লিটন হত্যা মামলার রায়ের দীর্ঘ সময় পরেও ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি হচ্ছে না। হাইকোর্টে দ্রুত ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি হওয়া উচিত। এ রকম একটি মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকতে পারে না। আমি আশা করি উচ্চ আদালতেও মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল থাকবে।’
মামলার বাদী লিটনের ছোট বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকুলী দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানিয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার সাড়ে চার বছর পেরিয়ে গেছে। আমরা চাই আদালতের ফাঁসির দ্রুত কার্যকর করা হোক। একশভাগ রায় কার্যকর দেখতে চাই। অতি দ্রুত রায় কার্যকরের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাইকোর্টে এখন ২০১৭ সালের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির কার্যক্রম চলছে। সেই হিসেবে এমপি লিটন হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনানি চলতি বছরে হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ বিবেচনায় শুনানির সময় এগিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব।
হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান সারাবাংলাকে জানান, হাইকোর্টে করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ সময় ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি বন্ধ ছিল। এখন আদালতের কার্যক্রম পুরোপুরে শুরু হয়েছে। করোনার প্রার্দুভাব আর যদি ব্যাপকভাবে বিস্তার না ঘটে তাহলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি হবে।
সারাবাংলা/কেআইএফ/এএম