Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এমপি-আমলা দ্বন্দ্ব!

মো. আসাদ উল্লাহ তুষার
৩০ জুন ২০২১ ২৩:০৮

নিবন্ধের শিরোনামেই দ্বন্দ্বের গন্ধ আছে। বেশ কিছুদিন হলো জনপ্রতিনিধি বিশেষ করে সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আমলাদের দ্বন্দ্বের কথা প্রচারিত হচ্ছে। অবশ্য এই প্রচারণা একবারে নতুন তা বলা যাবে না। এটা অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। মজার ব্যাপার হলো এমপি-আমলাদের দ্বন্দ্বের কথা যেখানে বলা হচ্ছে, বা মন্ত্রীর সঙ্গে আমলার দ্বন্দ্বের কথা যেখানে বলা হচ্ছে, সেখানে কিন্তু এই আমলারাই পরবর্তী সময়ে অবসর নিয়ে এমপি হচ্ছেন, মন্ত্রী হচ্ছেন। তখন কি তারা আমলাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছেন? নাকি তারা সাবেক আমলা হিসেবে এমপি বা মন্ত্রী হয়ে নতুন আমলাদের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে প্রশ্ন ওঠে, এমপি বড়, না আমলা- মানে সচিব বড়! অবশ্য প্রশ্নটা তোলেন সংসদ সদস্যরাই। আর এটা অনেকটা ক্ষোভ থেকেই তারা তুলে থাকেন। সংসদ সদস্যরাও জানে এমপি অনেক উপরের পদ। তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, আইন সভার সদস্য। যখন ক্ষমতা ও মর্যাদার প্ৰশ্ন আসে, বিশেষ করে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় আসে তখনই কে বড়, কেন বড়?- এসব প্রশ্ন ওঠে এবং দ্বন্দ্ব-মর্যাদা ও ক্ষমতার লড়াই চলে।

বিজ্ঞাপন

সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাপী যে করোনার তাণ্ডব, সেই তাণ্ডবের বাইরে কিন্তু বাংলাদেশ নেই। আমাদের দেশেও এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এই করোনা মহামারি কিন্তু হঠাৎ করেই বিশ্বে ছেয়ে যায়। এতে স্বাভাবিকভাবেই দেশের মানুষ অপ্রস্তুত ও হতচকিত হয়ে যায়। বিশেষ করে সরকার পড়ে বড়ধরনের সমস্যার সামনে। আসলে প্রথমদিকে অজানা এই রোগ নিয়ে সরকারের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। এমনকি এটা নিয়ে সেরকম প্রস্তুতি থাকারও কথা নয়। এই অবস্থায় জনপ্রতিনিধিরা যার যার মতো করে তাদের দায়িত্ব পালন করতে থাকে। মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে। পাশাপাশি সরকার আমলাদের দিয়েও করোনা মহামারি মোকাবিলার প্ৰস্তুতি নেয়। সরকার তো সবসময় পরিচালিত হয়ে থাকে সামরিক-বেসামরিক আমলা দিয়েই। এক্ষেত্রে সিভিল প্রশাসন, পুলিশ ও মিলিটারি প্রশাসন এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেহেতু এবারের এই বৈশ্বিক সমস্যাটি জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত, তাই এখানে অনিবার্যভাবে চলে আসে চিকিৎসকদের কথা। যারাও অনেকেই সরকারি আমলা, কিন্তু চিকিৎসক। এই যে সচিব, সরকারি হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক, আর্মি, পুলিশসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থায় কর্মরতরা- সবাই তো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বা কর্মকর্তা। এরা সবাই যার যার সুনির্দিষ্ট দায়িত্বে সমাসীন। এদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের বিশেষ করে এমপি-মন্ত্রীদের দ্বন্দ্ব ও বিরোধের কোনো অবকাশ থাকার কথা নয়।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের অনেকটা সময় ধরে সামরিক শাসন চলার কারণে সামরিক-বেসামরিক আমলারা সেই সময়েই বেশ ক্ষমতাধর হিসেবে নিজেদেরকে মেলে ধরেছিল। এর অবশ্য কারণও ছিল- তারা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত না হওয়ার কারণে আমলাদের ওপর অধিক নির্ভরশীল ছিল। সেসব সরকারে অনেক আমলাই অবসর নিয়ে সরাসরি মন্ত্রীও হয়েছেন। সামরিক শাসন অবসানের পর গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা কিছুটা কমতে থাকে। যদিও তার পরের পাঁচ বছরও অধিকহারে অবসরপ্রাপ্ত আমলারা বিভিন্ন দলে ঢুকে এমপি-মন্ত্রী হিসেবে দাপটের সঙ্গে ক্ষমতা ভোগ করেছেন। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর অনেক কালো তালিকাভুক্ত আমলা বিশেষ করে সচিবরা রাতারাতি বিএনপিতে যোগ দিয়ে এমপি-মন্ত্রী হয়ে যান। যা ছিল তখনকার সময়ে আন্দোলনকারী দলগুলোর নীতি ও ওয়াদা বিরোধী। পরের সরকারগুলোতে তুলনামূলক আমলাদের প্রাধান্য কমতে থাকে, বেড়ে যায় রাজনীতিবিদদের দাপট। বিশেষ করে নব্য রাজনীতিকদের দাপট, যারা কি না ব্যবসায়ী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল। অবশ্য সে কারণে এই নব্য ব্যবসায়িক রাজনীতিক ও প্রকৃত রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও একটা প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। যা এখনও বিদ্যমান।

করোনা মহামারির এই সময়ে সাময়িকভাবে ত্রাণ তৎপরতা ও স্বাস্থ্যসেবা সমন্বয়ের জন্য দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেওয়ার পর থেকেই নড়েচড়ে বসেছেন স্থানীয় সাংসদরা। অনেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবরা স্থানীয় সংসদ সদস্যদের অবহিত না করেই নানান পদক্ষেপ নিচ্ছেন। আবার অনেক জায়গায় দেখা গেছে, সচিবকে সংসদ সদস্যরা কোনোভাবে গ্রহণ করছেন না। বিশেষ করে যেসব সচিব তার নিজ জেলায় দায়িত্ব পেয়েছেন সেই এলাকার বর্তমান সংসদ সদস্যরা তাদের ভবিষ্যৎ ‘কাটা’ হিসেবে মনে করে তাদের সমস্ত কার্যক্রমকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। জনপ্রতিনিধিরা বারো মাস জনগণের সঙ্গেই থাকে। ভালো-মন্দ যাই হোক তারা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত এবং জনগণের পাশে থেকেই তাদের সেবা করে বা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে। এই মহামারির সময় হঠাৎ করে ত্রাণ তৎপরতা ও স্বাস্থ্যসুরক্ষা তদারকির কারণে যখন সচিবরা অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তায় এই কাজগুলো করতে যাচ্ছে তখনই এমপি-মন্ত্রীদের ‘ইগোতে’ লাগছে। এতে তারা নিজেদের ছোট মনে করছেন, ক্ষমতাহীন মনে করছেন। পত্রিকায় খবর বের হয়েছে, কোথাও কোথাও জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব কোনো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে স্থানীয় এমপিকে করেছেন সম্মানিত অতিথি। আবার অনেক জেলায় অনেক প্রভাবশালী সংসদ সদস্য রয়েছেন, যাদের নলেজের বাইরে গিয়ে সচিব নিজের মতো করে কিছুই করতে পারেনি। আবার অনেক জেলায় এমপিদের দাপটের কারণে সচিব সাহেবরা ঢাকায় বসে থেকেই নামে তদারকি করেছে। কিন্তু সব মিলিয়ে এমপি-মন্ত্রীরা তাদের ভেতরে ভেতরে মেনে নেয়নি বা নিতে পারেনি।

এই যে আমলাতন্ত্রের দাপট বা সচিবদের ক্ষমতা প্রদর্শন- এখানে কি এমপি সাহেবদের কোনো ব্যর্থতা নেই? নিশ্চয়ই আছে। অনেক এমপি আছেন যারা তাদের মর্যাদা সম্বন্ধে এখনও পুরোপুরি জানেন না। এর কারণ তিনি বা তারা রাজনীতি করে উঠে আসেননি। অপ্রত্যাশিতভাবে এমপি হওয়ায় তারা সচিবের কাছে নতজানু হয়ে থাকছেন। আবার সচিবরা চাকরি জীবনে দাপটের সঙ্গে আমলাগিরি দেখিয়েই এমপি-মন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে চলে। তারাই আবার অবসর গ্রহণ করে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ দেখাচ্ছে। এদের অনেকেই এমপি হয়ে যাচ্ছে। এমপি হয়েই তারা আবার আমলাদের খবরদারি মেনে নিচ্ছে না। যেমনটা উপজেলা চেয়ারম্যান এমপিদের খবরদারি মানতে পারেন না। তিনি আবার নিজে এমপি হয়ে সেই উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রতি একই পন্থা অবলম্বন করেন। যা এক ধরণের হীনমন্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী যার যার পদমর্যাদা সুনির্দিষ্ট করা আছে, যা সবারই মেনে চলা উচিত। মনে রাখা দরকার, এমপি-মন্ত্রীরা জনপ্রতিনিধি, আইন সভার সদস্য। তাদের সেই ব্যক্তিত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে চলা উচিত। তারা যতদিন পদে আছেন, তাদের সেই মর্যাদা দিতে হবে। আবার সচিব বা আমলারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাদের গুরুত্বও অপরিসীম। কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু নয়। সবাই জনগণের সেবক। সবাই দেশের জনগণের টাকা থেকে সম্মানী বা বেতন-ভাতাদি নিয়ে থাকেন।

সংসদ সদস্যরা যদি তাদের ওপর আরোপিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে থাকেন, বিশেষ করে সংসদ কার্য ও আইন প্রণয়নে এবং জনপ্রতিনিধি হিসেবে উচ্চমানে নিজেদের মেলে ধরতে পারেন তখন এই আমলা বা সচিবরা তাদের ওপর কোন অবস্থাতেই ক্ষমতা দেখাতে পারবে না। তাদের সেই ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্বের গুণাবলী থাকতে হবে। দেখা যায় অনেকেই পার্লামেন্টে কোনো কথা বলেন না। এমপি হিসেবে তার যে ভূমিকা সেটা সঠিকভাবে পালন করেন না। সারাদিন অফিসে অফিসে ছোটখাটো আমলাদের টেবিলে টেবিলে ঘোরাঘুরি করে নিজেদের ছোট করেন। তাদের কারণে অনেক আমলা আমলাগিরি দেখাতে সাহস করে। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা, যারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, তারা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে, সংসদে ভূমিকা রাখে, আইন প্রণয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখে, আমলাদের কার্যক্রম মনিটরিং করে বা তাদেরকে বিভিন্ন সময় জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসে- তখন কিন্তু এই মর্যাদার প্রশ্ন আসবে না। কারণ কার কি মর্যাদা সেটাতো সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। অতএব এই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এটা একান্তই নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাপার ছাড়া অন্য কিছু নয়। যা সবারই একটা সময় পর্যন্ত থাকে। এমপি-মন্ত্রীদের ক্ষমতা, জেলখানা ও জবাবদিহিতা পায়ে পায়ে চলে। সচিবদের তাদের বস ছাড়া কারও কাছেই তেমন জবাবদিহিতা নেই। তারা জনপ্রতিনিধি না, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। এদেরও শখ থাকে একদিন এমপি-মন্ত্রী হওয়ার, হয়ও অনেকেই। অতএব বড় কে, এদের সবই জানা। দ্বন্দ্বের কারণও এদের অজানা নয়। এদের কেউই আসলে বড় না। বড় হলো দেশের জনগণ, যারা দেশের প্ৰকৃত মালিক। সবচেয়ে বড় হলো দেশ। তাই এমপি, মন্ত্রী, আমলা, সচিবদের হওয়া উচিত দেশের সেবক। কারণ সবার উপর দেশ।

লেখক: কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

এমপি-আমলা দ্বন্দ্ব!