বড় ধরনের প্রতারণার ঠেকাতে আসছে ই-কমার্স নীতিমালা
৫ জুলাই ২০২১ ১৬:৩০
ঢাকা: ৫০ হাজার টাকা দামের টেলিভিশন পাওয়া যাচ্ছে ২৫ হাজার টাকায়, ৭০ হাজার টাকার ফ্রিজ দিচ্ছে মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকায়। শুধু টিভি কিংবা ফ্রিজ-ই নয়, মোটরসাইকেল, এসি, গাড়ি, ঘড়িসহ মানুষের প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র এখন অর্ধেক দামেই পাওয়া যাচ্ছে— এমন লোভনীয় অফার দিয়ে আকৃষ্ট করার প্রতিযোগিতা চলছে ই-কমার্স বাণিজ্যে। সরকার মনে করছে, উদীয়মান এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা পদ্ধতি জনগণের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করছে এবং যেকোনো সময় বড়ধরনের প্রতারণা হতে পারে। সেই আশঙ্কা থেকে ই-কমার্সের জন্য দিক নির্দেশনা তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। চলছে এ সংক্রান্ত নীতিমালার কাজও।
জানা গেছে, ক্রেতাদের কাছ থেকে আগে অর্থ নিয়ে পরে পণ্য বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তবে বিভিন্ন ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে অনলাইনে পণ্য অর্ডার করার পর তা হাতে পেতে দেড় থেকে দুই মাস সময় লেগে যায়। আবার কেউ কেউ তিনমাস পরেও পণ্য পেয়েছেন। আবার অনেকের না পাওয়ার অভিজ্ঞতাও রয়েছে। বাংলাদেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো লোভনীয় অফার দিয়ে প্রথমে ক্রেতা আকৃষ্ট করে থাকে। কোনো কোনো সময় কয়েক ঘণ্টার জন্য সেই অফারে পণ্যের মূল্য ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়। লোভনীয় অফার দিয়ে ক্রেতা আকৃষ্ট করার তালিকায় রয়েছে আলিশা মার্ট, ই-ভ্যালি, বুমবুম, দালাল প্লাস, ধামাকা শপিং, আনন্দের বাজার, কিউকুম, ই-নিডস্, পল্লীবাজারসহ একাধিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। ধামাকা অফার পদ্ধতিতে পণ্য বিক্রি করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন এরই মধ্যে আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
অনলাইন বাজার থেকে নিয়মিত কেনাকাটা করেন এমন একজন ক্রেতা সুমন চৌধুরী। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি পেশায় ব্যাংকার। অনলাইন মার্কেট থেকে মাঝে-মধ্যে সস্তায় পণ্য কিনে থাকে। তবে সেই পণ্য পেতে দুই থেকে তিন মাস সময় লেগে যায়।’ একই অভিযোগ আরেক ক্রেতা তৌহিদুল ইসলামের। তিনি জানান, একটি নামকরা অনলাইন মার্কেট মোটরসাইকেল কিনেছেন অর্ধেক দামে। অফারে আরও দুটি অর্ডার করেছেন। যা হাতে পেতে আরও এক মাস সময় লাগবে। তবে পণ্য না নিতে চাইলে বাজার মূল্যের চেক দেয় প্রতিষ্ঠানটি। যে চেক থেকে টাকা ক্যাশ হতে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় মাস সময় লেগে যায়।
এদিকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন পলিসি ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কারণে এরই মধ্যে আলেশা মার্ট, ইভ্যালিসহ ১০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঢাকা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক ক্রেডিট, ডেবিট এবং প্রিপেইড কার্ডের লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো এমন লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহকের কাছে পণ্য সরবরাহের আগেই অর্থ নিয়ে নিচ্ছে এবং তা নিয়ে হয়রানির অভিযোগ এসেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পণ্য গ্রাহকের হাতে পৌঁছানোর পরই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অর্থ পাবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা নিয়ন্ত্রণ করবে— এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ক্যাশঅন ডেলিভারি অর্থাৎ ক্রেতাকে পণ্য বুঝিয়ে দেওয়ার পরেই অর্থ পাবেন এমন বিষয়ের ওপরে জোর দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিল পেমেন্ট পদ্ধতিতে বড়ধরনের পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, পণ্য ডেলিভারির পর গেটওয়েরা যখন তথ্য পাবে তখন তারা ই কমার্স প্রতিষ্ঠানের পেমেন্ট রিলিজ করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ক্রেডিট কিংবা ডেবিট কার্ডে লেনদেনের গেটওয়ে রয়েছে। এর মাধ্যমে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্রাহকের লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।’
বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যাবসার উত্থান বেশি দিনের নয়। এক দশক ধরে সীমিত পরিসরে শুরু হলেও গত দেড় বছরে এর জয় জয়কার। এখন রীতি মতো প্রতিযোগিতা চলছে। ক্রেতা ধরার প্রতিযোগিতায় আস্থা হারাচ্ছে ভালো ই-কমার্স কোম্পানিগুলো। প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ক্রেতারা।
এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘কিছু প্রতিষ্ঠান ভোক্তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যথাসময়ে পণ্য দিচ্ছে না। তথ্য রয়েছে- ভোক্তাদের কাছ থেকেই নয়, যারা পণ্য সরবরাহ করে তাদের টাকাও এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে জমা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দুই দিক থেকেই একটা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ই-কমার্সগুলোর এই পলিসি মানুষকে হয়রানি করছে— এমন অভিযোগ সামনে রেখেই নির্দেশনা তৈরি করেছে সরকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে বিষয়টা এমন হয়েছে যে, ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে পণ্য ডেলিভারির কথা বলে অর্থ সংগ্রহ করছে। কিন্তু গ্রাহকদের পণ্য বুঝিয়ে দিতে দেরি করছেন কিংবা অনেক ক্ষেত্রে পণ্যই দিচ্ছে না। ফলে গ্রাহক ও পরিশোধ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। যে কারণে ডিজিটাল কমার্স সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর জনগণের আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে।’
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নির্দেশনা জারি করেছে। গত বুধবার (৩০ জুন) জারি করা নির্দেশনায় ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মূল্য ছাড়করণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ই- কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের পণ্য বা সেবা বুঝিয়ে না দিয়ে বিক্রয় মূল্য পাবে না। যেসব প্রতিষ্ঠান পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে গ্রাহকের কাছে পণ্য বা সেবা পৌঁছে দেবে, তারা সহজেই ওই সেবা বা পণ্য বাবদ অর্থ পাবেন। অর্থাৎ ক্রেতা পণ্য হাতে পাওয়ার পরই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের হিসাবে অর্থ পরিশোধ হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মেসবাউল হকের সই করা নির্দেশনায় আরও বলা হয়, দেশের সব ব্যাংক, বিকাশ, রকেট, নগদের মতো মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (এমএফএস) ও ডি মানি, আই-পে’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
ই-কমার্স নিয়ে সরকারের এসব সিদ্ধান্তের বিষয়ে বর্তমানে আলোচিত একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের কাছে তাদের পদক্ষেপের কথা জানতে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তবে তার প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা মেনেই তারা ব্যবসা করবেন। এ নিয়ে তাদের অভ্যন্তরীণ বৈঠক হয়েছে।’ সেক্ষেত্রে বর্তমান পলিসিতে পরিবর্তন আনা হতে পারে বলে জানান তিনি।
এদিকে বাংলাদেশে ই- কমার্স বাণিজ্যের প্রসার ঘটলেও এর জন্য আলাদা কোনো আইন নেই। তবে ই- কমার্সকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসতে একটি নীতিমালা তৈরি করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, যা চূড়ান্তের পথে। সেখানে পণ্যের অর্ডার দেওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া, তাতে ব্যর্থ হলে অগ্রিম নেওয়া মূল্য জরিমানাসহ ফেরত দেওয়া এবং খারাপ ও মানহীন পণ্য সরবরাহকে ফৌজদারি আইনের আওতায় প্রতারণা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ই-কমার্স নীতিমালা ২০২১ এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এখন সে খসড়ায় সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। মতামত নেওয়া শেষ হলে এটি চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হবে। বিদ্যমান অসঙ্গতি কমানোর পাশাপাশি গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের মাধ্যমে সরকার ই-কমার্স খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্যই এই নীতিমালা প্রণয়ন করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম