রেজাউল-সুজনকে ‘এক করা’র চেষ্টায় নওফেল
১ আগস্ট ২০২১ ২৩:২২
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই রেজাউল করিম চৌধুরী তার আগে মাত্র ছয় মাস প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করা খোরশেদ আলম সুজনের অনিয়ম খুঁজতে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এর জের ধরে একই দলের দুই জ্যেষ্ঠ্য নেতার মধ্যে তৈরি হয়েছে দূরত্ব। তাদের পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেওয়ার বিষয়টি পৌঁছেছে সরকার ও আওয়ামী লীগের শীষ পর্যায়ে। তবে ঊর্ধ্বতনরা চান না, দলীয় নেতাদের বিভক্তিতে সিটি করপোরেশনের কাজের গতি স্তিমিত হোক।
দল ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীকে কোন্দলে না জড়ানোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব ঘোচানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। এরই মধ্যে দুই নেতার সঙ্গে তিনি আলাদাভাবে কথা বলেছেন। নওফেলের পাশাপাশি দলের একজন প্রবীণ নেতা ও একজন পূর্ণ মন্ত্রীকেও দুই নেতার সঙ্গে কথা বলে বিরোধ মেটানোর তাগাদা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে খোরশেদ আলম সুজন বলেছেন, ‘আমি কারও সঙ্গে ফজ্জাতে (ঝামেলায়) যেতে চাই না। কাউকে ডিস্টার্ব করার রাজনীতি আমি করি না।’ অন্যদিকে রেজাউলের বক্তব্য হচ্ছে— কারও প্রতি তার ব্যক্তিগত বিদ্বেষ কিংবা রাগ-ক্ষোভ নেই।
খোরশেদ আলম সুজন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। রেজাউল করিম চৌধুরী একই কমিটির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের জন্য দুই নেতাই মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন পান রেজাউল করিম। ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছিল। ওই সময়কার মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সরকার গত বছরের ৬ আগস্ট থেকে ছয় মাসের জন্য খোরশেদ আলম সুজনকে প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়। গত ৫ ফেব্রুয়ারি সুজনের মেয়াদ শেষ হয়।
এর মধ্যে ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত চসিক নির্বাচনে বিজয়ী হন রেজাউল করিম চৌধুরী। ১৫ ফেব্ররুয়ারি তিনি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন। এর আগে সুধী সমাবেশ করে চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনদের পরামর্শ নেন তিনি। সেই সমাবেশে চসিকের সদ্যবিদায়ী প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনও ছিলেন। তিনি মেয়রকে চসিককে স্বাবলম্বী করতে আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ‘চোখ-কান’ খোলা রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
এর আগে, চসিক প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় খোরশেদ আলম সুজন তার আগের মেয়াদে বিভিন্ন কাজে দুর্নীতি-অনিয়মের বেশকিছু তথ্য উদঘাটন করেন। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন। মাত্র ছয় মাসের কর্মকাণ্ডে সাড়া ফেলেছিলেন সুজন, যার ফলে তিনি গণমাধ্যমে বারবার আলোচনায় আসেন।
মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দায়িত্ব নেওয়ার পর চসিকের নির্বাচিত পরিষদের তৃতীয় মাসিক সাধারণ সভায় প্রশাসক হিসেবে ছয় মাসের দায়িত্ব পালনের সময় খোরশেদ আলম সুজন জায়গা বরাদ্দে কোনো অনিয়ম করেছিলেন কি না, সেটি জানতে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। পরে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
জানতে চাইলে দখোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার মেয়াদে যেসব জায়গা ইজারা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো কখনোই করপোরেশনের দখলে ছিল না। এমনকি রেকর্ডপত্রেও ছিল না। বেহাত জায়গা উদ্ধার করে করপোরেশনের সব নিয়মনীতি মেনে অস্থায়ী ভিত্তিতে স্বল্প মেয়াদের জন্য কাউকে ছয় মাস, কাউকে এক বছরের জন্য ইজারা দিয়েছি। করপোরেশনের আয়ের খাত মজবুত করার জন্যই করেছি। যারা সর্বোচ্চ দর দিয়েছে, তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
একই বিষয়ে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘জেল রোডে ফুটপাতের ওপর নার্সারি বানানো হয়েছে। মাদারবাড়িতে করপোরেশনের জায়গা ইজারা দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে পত্রপত্রিকায় সংবাদ এসেছে। আমি তো চেয়ারে বসেই কারও ইজারা বাতিল করে দিইনি। যেহেতু পত্রিকায় সংবাদ এসেছে, আমি প্রথমে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছি। স্বচ্ছতার জন্যই করেছি, কারও প্রতি রাগ-ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে নয়। তদন্ত এখনো চলমান। দেখি, তদন্ত কমিটি কী রিপোর্ট দেয়!’
দুই নেতার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছয় মাসের দায়িত্ব পালনের সময় সুজনের বিরুদ্ধে গুরুতর কোনো অভিযোগ ওঠেনি। আকস্মিকভাবে চসিকের জায়গা ইজারা দেওয়ার একটি বিষয়কে সামনে এনে তদন্তের উদ্যোগের ঘোষণায় বিস্মিত হন সুজন। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে একসময় একই বলয়ে থাকা রেজাউল ও সুজনের পথ এরপর থেকে কার্যত আলাদা হয়ে যায়। বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতিও আসে।
ধারাবাহিক এসব ঘটনা নিয়ে কেন্দ্রীয় ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মিলিয়ে কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে সারাবাংলার। জানা গেছে, দুই নেতার মধ্যকার হঠাৎ বিরোধ নিয়ে সাংগঠনিকভাবে অনুসন্ধান হয়েছে। বিরোধের নেপথ্যে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন দেখছেন কেউ কেউ। এ অবস্থায় তাদের মধ্যে বিরোধ যেন আর না বাড়ে, সেজন্য সরকার ও দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে দলের একজন প্রবীণ নেতা, একজন পূর্ণ মন্ত্রী এবং চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনের সাংসদ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
দুই নেতার সঙ্গে আলাদা-আলাদাভাবে কথা বলে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার তাগিদ দেন আওয়ামী লীগের সেই প্রবীণ নেতা ও পূর্ণ মন্ত্রী। অন্যদিকে গত ২১ জুন খোরশেদ আলম সুজনের বাসভবনে যান উপমন্ত্রী নওফেল। তখন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন সাংগঠনিক সফরে চট্টগ্রামে ছিলেন। নওফেল প্রথমে সুজন ও পরে মেয়র রেজাউলের সঙ্গে দেখা করে তাদের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের ইঙ্গিত সম্পর্কে অবহিত করেন বলে জানা গেছে।
পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত থাকা নগর আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য সারাবাংলাকে বলেন, “নওফেল সাহেব নিজ থেকে যাননি। আমরা যতটুকু জেনেছি, তাকে একটি দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল। সেটি সরকার ও দল— উভয় পর্যায় থেকেই। অতীতের অভিজ্ঞতায় শীর্ষ পর্যায় চায় না, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র অহেতুক কোনো বিভক্তিতে জড়িয়ে পড়ুক। কোন্দল-গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে সিটি করপোরেশনের কাজে ব্যাঘাত ঘটুক— এটি প্রত্যাশিত নয় শীর্ষ পর্যায়ের। নওফেল সাহেব মেয়রকে কোন্দলে না জড়ানোর জন্য দল ও সরকারের মনোভাবের কথা অবহিত করেছেন। একইভাবে সাবেক প্রশাসককেও মেয়রকে কোনো ধরনের ‘ডিস্টার্ব’ না করার জন্য ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের বার্তা জানিয়ে দিয়েছেন।”
জানতে চাইলে খোরশেদ আলম সুজন উপমন্ত্রী নওফেলের সঙ্গে বৈঠকের কথা স্বীকার করলেও সুনির্দিষ্ট কোনো বার্তার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘উনার (নওফেল) সঙ্গে সাংগঠনিক আলাপ হয়েছে। সেখানে নানা প্রসঙ্গ এসেছে। আমার পক্ষ থেকে মেয়র সাহেবের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই। আমি তো কোনো ফজ্জাতে (ঝামেলায়) যেতে চাই না। আমি উনাকে (মেয়র) সহযোগিতার জন্য বরং সিটি করপোরেশন নিয়ে একটি প্রস্তাবনা রেডি করেছিলাম। সেখানে কীভাবে করপোরেশের আয় বাড়ানো যাবে, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করা যাবে, দুনীতি-অনিয়ম রোধ করা যাবে— সে সম্পর্কে খাতওয়ারি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা আছে।’
‘আমি প্রশাসকের দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি জনগণের সামনে তুলে ধরে সেগুলো বন্ধ করেছি। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় দেওয়া বরাদ্দ বাতিল করেছি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত করেছি, শাস্তি দিয়েছি। সেজন্য করপোরেশনের ভেতর-বাইরের সুবিধাভোগী চক্র আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে। তারা হয়তো মেয়র সাহেবকে আমার সম্পর্কে ভুল বুঝিয়েছেন। কিন্তু একদিন উনার ভুল ভাঙবে। স্বার্থান্বেষী চক্রকে উনি চিনতে পারবেন। কারণ, উনি রাজনীতির দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মেয়রের চেয়ারে বসেছেন। আমি সবসময় উনাকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত,’— বলেন সুজন।
অন্যদিকে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এ ধরনের বার্তা পাওয়ার কথা সরাসরি অস্বীকার করেছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোনো নেতা-মন্ত্রী আমাকে এ বিষয়ে কিছু বলেননি। তবে আমি এতটুকু বলতে পারি, সুজন সাহেবের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। তার প্রতি আমার কোনো ব্যক্তিগত বিদ্বেষ, রাগ-ক্ষোভ নেই। তিনি রাজনীতিতে আমার চার-পাঁচ বছরের জুনিয়র। শুধু উনি কেন, কারও সঙ্গেই রাজনৈতিক গ্রুপিংয়ে জড়ানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই।’
‘এটি ঠিক যে প্রশাসকের মেয়াদকালে কী পরিমাণ জায়গা ইজারা দেওয়া হয়েছে, কী পরিমাণ নালা-নর্দমা-ফুটপাতের ওপর অবৈধ স্থাপনা তৈরি হয়েছে— সেগুলোর বিষয়ে আমি তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছি। তবে এটি কেবল মেয়রের একার সিদ্ধান্ত নয়। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সাধারণ সভায়। তদন্তের উদ্যোগ নেওয়ায় হয়তো কারও কারও মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে যে আমি গ্রুপিং করছি। বাস্তবে আমার সে ধরনের কোনো ইচ্ছা নেই। তবে পত্রপত্রিকায় নিউজ আসছে যে অমুক জায়গা দখল হয়ে আছে, অমুক স্থানে ফুটপাত দখল হয়ে আছে। মানুষ ভাবছে, আমি মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর বোধহয় এটি হয়েছে। আগের মেয়াদের কোনো অনিয়মের দায়ভার যেন আমার ওপর না আসে, সেজন্য কিছু পদক্ষেপ আমি নিয়েছি। ইনটেনশনালি কিছুই করিনি,’— বলেন মেয়র রেজাউল।
রেজাউল ও সুজনের মধ্যেকার দূরত্ব কমানোর উদ্যোগের বিষয়টি নাকচ করেননি উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘একান্তই আমাদের সাংগঠনিক অভ্যন্তরীণ বিষয়। দু’জন নেতারই দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস আছে। প্রধানমন্ত্রী দু’জনকেই মূল্যায়ন করেছেন, সম্মানজনক পদে দিয়েছেন। দু’জনের মধ্যে যদি কোনো বিরোধ দৃশ্যমান হয়, তাহলে কর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে। তবে আবারও বলছি, এগুলো একান্তই আমাদের সাংগঠনিক বিষয়। এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি যদি দেখা দেয়, তাহলে কর্মীরা আশা করেন যে আমাদের অভিজ্ঞ দুই নেতাই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেবেন।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
খোরশেদ আলম সুজন চসিক মেয়র মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল মেয়র রেজাউল করিম রেজাউল করিম চৌধুরী