কমিটিতে আরও ১৫% নারী নিচ্ছে বিএনপি, তৃণমূলে চিঠি
২৪ আগস্ট ২০২১ ২৩:০২
ঢাকা: বিএনপিপ্রধান একজন নারী হলেও এতদিন দলটির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর অবস্থান ছিল একেবারেই নগণ্য। ৫০২ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে নারীর সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। বিভিন্ন ইস্যুতে গঠিত সাময়িক (টেম্পোরারি) কমিটি, যেমন— জাতীয় কাউন্সিল আয়োজন কমিটি, নির্বাচন পরিচালনা কমিটি, জাতীয় দুর্যোগ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও ত্রাণ বিতরণ কমিটিতে তো নারীদের রাখাই হতো না। অথচ দলটিতে হাজার হাজার নারী কর্মী ও সমর্থক রয়েছেন।
দলে নারী-পুরুষের এই বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বিএনপি। দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সংক্রান্ত একটা প্রস্তাবনা পাস হয়েছে। এরই মধ্যে সব ধরনের কমিটিতে আরও ১৫ শতাংশ মহিলা সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কেন্দ্র থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে তৃণমূলে। গত শনিবার (২১ আগস্ট) দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরে সই করা ওই চিঠি এরই মধ্যে তৃণমূলে পাঠানো হয়েছে। চিঠির একটি কপি সারাবাংলার হাতে এসে পৌঁছেছে।
বিএনপির সাংগঠনিক জেলা ও মহানগর শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক/ আহ্বায়ক-সদস্য সচিব বরাবর পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত মোতাবেক দলের গঠনতন্ত্রের বিধান বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জেলা ও মহানগর কমিটিতে আরও ১৫ শতাংশ মহিলা সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
দলের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আগামী ১৫ দিনের মধ্যে জেলা ও মহানগর কমিটি অথবা আহ্বায়ক কমিটির সভা করে বর্তমান সংখ্যার ১৫ শতাংশ মহিলা সদস্যের নামের তালিকা প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রস্তাবকৃত মহিলা সদস্যদের দলে আনুগত্য, সক্রিয় ভূমিকা, বয়স, যোগ্যতা, দল ও সমাজে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে ওই চিঠিতে।
আরও পড়ুন- বিএনপিতে উপেক্ষিত নারী
তৃণমূলে চিঠি দেওয়ার কথা স্বীকার করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে রাজনৈতিক দলে ৩৩ শতাংশ নারী পদ পূরণের বিধান করেছে। তাছাড়া আমাদের দলের গঠনতন্ত্রেও এ বিষয়টি আছে। সে কারণেই আমরা কমিটিতে আরও ১৫ শতাংশ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এক-এগারো সময়কার এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে রাজনৈতিক দলে ৩৩ শতাংশ নারী পদ পূরণের বিধান অন্তর্ভুক্ত করে। আরপিওতে অধ্যায়টি সংযোজন করে প্রচলন করা হয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য বাধ্যতামূলক দল নিবন্ধন প্রক্রিয়া। সেখানে নিবন্ধন পাওয়ার অন্যতম শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়— ২০২০ সালের মধ্যে দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী পদ পূরণ করতে হবে।
তবে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন-২০২০ প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রস্তুত করা খসড়া আইনে এ বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হয়েছে। ৩৩ শতাংশ নারী রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা রাজনৈতিক দলের ওপরই ছেড়ে দেয় ইসি। কিন্তু সব মহল থেকে সমালোচনা শুরু হলে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসে নির্বাচন কমিশন। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে হলে সব পর্যায়ের কমিটিতে এখন ৩৩ শতাংশ নারী রাখা বাধ্যতামূলক, যদিও তা বাস্তবায়নের জন্য সময় বাড়ানো হচ্ছে।
কিন্তু বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির ১৯ পদের মধ্যে এই মুহূর্তে নারী সদস্য মাত্র দু’জন। ২০১৬ সালে কমিটি ঘোষণার সময় এই পদে খালেদা জিয়া ছাড়া আর কোনো নারী ছিলেন না। দুই বছর আগে বেগম সেলিমা রহমানকে স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করায় এই মুহূর্তে এখানে নারী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই জনে। অথচ নির্বাচন কমিশনের শর্ত অনুযায়ী, ১৯ সদস্য বিশিষ্ট স্থায়ী কমিটিতে কমপক্ষে ছয় জন নারী থাকতে হবে।
বিএনপির চেয়ারপারসনের ৭৩ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদে নারী মাত্র ছয় জন। তারা হলেন— সারোয়ারী রহমান, অধ্যাপিকা তাজমিরী ইসলাম, অধ্যাপিকা ড. শাহিদা রফিক, রোজী কবির, তাহসীনা রুশদির লুনা ও আফরোজা খান রিতা। অর্থাৎ এই পরিষদে নারীর উপস্থিতি মাত্র ৮ শতাংশ। নির্বাচন কমিশনের আরপিও’তে যে ৩৩ শতাংশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেটি পূরণ হতে এখনো ঢের বাকি।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান পদ ৩৫টি। কমিটি ঘোষণার সময় এই পদে নারী ছিলেন মাত্র দু’জন— মিসেস রাবেয়া চৌধুরী ও বেগম সেলিমা রহমান। সেলিমা রহমানকে গত বছর স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার পর এই মুহূর্তে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নারী সদস্য মাত্র এক জন। অর্থাৎ শতাংশের বিচারে বিএনপির ভাইসচেয়ারম্যান পদে নারী রয়েছে তিন শতাংশের কম।
বিএনপিতে মহাসচিব ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদ ছাড়াও সাতটি যুগ্ম মহাসচিব পদ রয়েছে। এ সাতটি পদে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মজিবুবর রহমান সারোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, হারন-অর-রশিদ ও আসলাম চৌধুরী দায়িত্ব পালন করছেন। অর্থাৎ দলের গুরুত্বপূর্ণ এই পদে কোনো নারী সদস্যকেই রাখেনি বিএনপি।
অবশ্য বিএনপির ১০টি সাংগঠনিক সম্পাদক পদের মধ্যে দুইটি পদে দু’জন নারীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফজলুল হক মিলন (ঢাকা), মাহবুবুর রহমান শামীম (চট্টগ্রাম), রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু (রাজশাহী), নজরুল ইসলাম মঞ্জু (খুলনা), আসাদুল হাবিব দুলু (রংপুর), ডা. শাখাওয়াত হোসেন জীবন (সিলেট), কর্নেল (অব.) আনোয়ারুল আজীম (কুমিল্লা) ও এমরান সালেহ প্রিন্সের (ময়মনসিংহ) পাশাপাশি বরিশাল এলাকার জন্য বিলকিছ জাহান শিরিন ও ফরিদপুর এলাকার জন্য শামা ওবায়েদ সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এখানেও শতাংশের হারে নারী রয়েছেন মাত্র ২০ শতাংশ, যা আরপিও’র ৩৩ শতাংশ থেকে যথেষ্ট দূরে।
বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদ পাঁচটি। এর একটিতেও নেই নারী সদস্য। অবশ্য সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সাতটি পদের মধ্যে তিনটি পদে তিন জন নারী রয়েছেন। তারা হলেন— অ্যাডভোকেট ফাহিমা মুন্নী, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা ও বেবি নাজনীন। এছাড়া সম্পাদকমণ্ডলীর ৪৪টি পদের মধ্যে নারী রয়েছেন মাত্র তিন জন— মহিলা বিষয়ক সম্পাদক নূর এ আর সাফা, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক রাশেদা বেগম হীরা ও স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক শিরিন সুলতানা।
এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে সহসম্পাদক পদে এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য পদে বেশ কয়েকজন নারী থাকলেও শতাংশ হারে তা তিন-চার শতাংশের বেশি না। শুধু নির্বাহী কমিটি নয়, বিভিন্ন সময় গঠিত সাময়িক (টেম্পোরারি) কমিটিতে একজন নারীকেও রাখা হয় না।
এমন এক বাস্তবতায় বিএনপির রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে আরও ১৫ শতাংশ নারী অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এই সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী এবং সাহসী সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন দলটির নারী সদস্যরা। এ সিদ্ধান্তে তারা যারপরনাই খুশি।
এ প্রসঙ্গে মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য খুবই আশাব্যাঞ্জক এবং আনন্দের খবর। এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। আশা করছি দলের ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্বের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেটা এবার পূরণ হবে।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর