ইসি গঠনে ‘সার্চ কমিটি’র উপর আস্থা নেই বিরোধীদলগুলোর
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:০০
ঢাকা: ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যে বিদায় নিচ্ছেন বর্তমান কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তাই তোরজোড় শুরু হয়েছে নতুন ইসি গঠনের। এমনকি এই প্রক্রিয়ার জন্য সার্চ কমিটির বিষয়টিও উঠে আসছে আলোচনায়। কিন্তু ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে সার্চ কমিটির উপর আস্থা নেই দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর। তারা বলছে, এর আগে সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি, সর্বজন স্বীকৃত ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। এজন্য সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে মতামত নিতে হবে। এছাড়া সংবিধান অনুযায়ী বা নির্দেশনা মতে, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে।
তাদের মতে, এখনও আইন প্রণয়নের যথেষ্ট সময় রয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের কেউ কেউ বলেছন, দুই বছরের জন্য জাতীয় সরকার গঠন করে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম করতে হবে। আবার কেউ বলছেন, আইনের আশ্রয় নেবেন। এছাড়া রাষ্ট্রপতিসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করে দাবি আদায়ের চিন্তা করছে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল।
ইসি গঠন বিষয়ে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সেই হিসেবে দলনিরপেক্ষ, নীতি-নিষ্ঠ ও সর্বজন স্বীকৃত ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা উচিত। তবে তা একটি বিধানের মধ্যে দিয়ে করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে কখনই নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না। কেননা নির্বাচন ব্যবস্থার ভেতর অনেক আগে থেকেই পক্ষপাতিত্বের উপাদান বিরাজ করছে। তাই নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু করতে হবে। টাকার খেলা, পেশী শক্তির দাপট, সাম্প্রদায়িক প্রচারণা ইত্যাদির হাত থেকে নির্বাচনি ব্যবস্থাকে মুক্ত করতে হবে। প্রার্থীদের ব্যক্তিগত খরচের বিষয়টি নিষিদ্ধ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন থেকে সকল প্রার্থীর হ্যান্ডবিল, পোস্টার ছাপিয়ে দিতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা একটা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছি।’
নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো কর্মসূচি আছে কি না? জবাবে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ নয়, আমরা তার কার্যালয় ঘেরাও করব।’
সার্চ কমিটির বিষয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু সারাবাংলাকে বলেন, ‘সদ্য শেষ হওয়া অধিবেশনে নির্বাচন কমিশন আইনটি প্রণয়নের করার জন্য সংসদে বলেছি। ওই সময় সংসদ নেতা শেখ হাসিনা অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। আমি সংসদে বলেছি, আপনারা যদি আইনটি সংসদে আনতে না পারেন বলেন; আমিই সবকিছু ঠিক করে আইনটি নিয়ে আসি। কারণ, সংবিধানে নির্দেশনা রয়েছে, নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার আমাদের কথা গুরুত্ব দিচ্ছে না। এখন নিজে উদ্যোগ নিয়ে বেসরকারিভাবে এই আইনটি সংসদে এনে লাভ কী? সরকার তো পাস করবে না।’
আরও পড়ুন: হুদা কমিশনের বিদায়ের আগেই নাসিক-কুসিকসহ সব ইউপি নির্বাচন
গণফোরামের (ড. কামাল হোসেন) ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শফিক উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয় নিয়ে আমরা আইন প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছি। কোনো কারণে সরকার আইন প্রণয়ন না করলে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনার জন্য একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির শরণাপন্ন হব। প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে যদি সার্চ কমিটি দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়, সেই সার্চ কমিটি ও সব রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে করতে হবে।’ এ সব বিষয় নিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে শিগগিরই বৈঠকে বসা হবে বলে জানান তিনি।
ইসি গঠন বিষয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই বছরের জন্য জাতীয় সরকার গঠন করা যেতে পারে। ওই সরকার সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কার্যক্রর পদক্ষেপ নেবে।’ তিনি বলেন, ‘এসব দাবি আদায় করতে হলে যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের হাঁটু ভাঙা। আর রাজনৈতিক দলগুলোর কোমর ভেঙে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির শরণাপন্ন হয়ে কোনো লাভ নেই। আমার প্রস্তাব জাতীয় সরকার গঠন। সেটিও যে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তা নয়। সেজন্য এই প্রস্তাব জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে।’ জাতীয় সরকারের প্রধান কে হবেন? আপনার প্রস্তাব কী? জবাবে তিনি বলেন, ‘সেটি জনগণ ঠিক করবে। তবে আমার মতে ড. ইউনুস হতে পারে, ড. কামাল হোসেন হতে পারে।’
ইসি গঠনে সার্চ কমিটির বিষয়ে জাসদ সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠন করবে সরকার। তবে এ ব্যপারে আমাদের প্রস্তব হচ্ছে, সংবিধান ও আইন অনুযায়ী বাধ্যবাধকতাসহ সর্বজন স্বীকৃত ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে যে রীতি চালু আছে সেটি হলো, রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি সার্চ কমিটি গঠন। আমি মনে করি, আইনগত কাঠামোর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা সম্ভব। আর নির্বাচন কমিশনে যারা থাকবেন, তারা যেন সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকেন।’ ইনু বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি সরকারের কাছে অগ্নিপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সরকারকে এখনই সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে।’
গণফোরাম নেতা, সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা মহসিন মন্টু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া এর আগেও দেখেছি। এমনকি তাদের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনাও দেখেছি। এই সার্চ কমিটির উপর আমাদের আস্থা নেই। সুস্থ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত, কালো টাকার দৌরাত্ম বন্ধ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের মতামত নিয়ে ইসি গঠন করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির বিষয় নিয়ে আমাদের দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করব কি করব না, সে বিষয়েও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সার্চ কমিটির বিষয়টি আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করিনি। এ ব্যাপারে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি বৈঠক করে সিদ্ধান্ত জানাবে। তবে সরকার সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে সার্চ কমিটি গঠন করলে আমরা সমর্থন জানাব।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহামুদুর রহমান মান্না সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয় নিয়ে আমি ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে মাথা ঘামাই না। যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংসদে কোনো বিল আনা হয়নি, সেহেতু বোঝা যায়, তারা আগের মতোই ইসি গঠন করবে। এই সরকার ক্ষমতায় থেকে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করলে, সেই কমিশন তাদের কথার বাইরে যাবে না। ফলে নির্বাচন কেমন হবে তা অতীতের নির্বাচন থেকেই বোঝা যায়। তবে এখন সরকারের পদত্যাগ করা উচিত। এরপর যারা সরকারে আসবে তারাই নির্বাচন কমিশন গঠন করবে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন গত ৫০ বছরেও হয়নি। আমি মনে করি, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য দেশের ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে, তাদের মতামত নিয়ে নির্বাচন কমিশন আইন করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘এর আগে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য যে সার্চ কমিটি করা হয় তা আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। ওই সার্চ কমিটি দিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। তাদের ভূমিকা দেশবাসী জানে। মনে হয় তারা সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠন হয়ে কাজ করছে।’
নির্বাচন কমিশন গঠন করার বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করবেন কি না? জবাবে সাইফুল হক বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে কোনো লাভ নেই। কারণ, রাষ্ট্রপতির প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির বাইরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। রাষ্ট্রপতি তার নৈতিক ক্ষমতা পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারেন না। আমরা এখনও তার নৈতিক ক্ষমতা দেখিনি। দেশের বিশিষ্ট ৩২ জন নাগরিক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন। তিনি সময় দেননি।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম