রাজধানীতে এবারও হলো না কুমারী পূজা
১৩ অক্টোবর ২০২১ ১৪:৩৩
ঢাকা: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জনসমাগম এড়াতে টানা দ্বিতীয়বারের মতো দুর্গাপূজার মহাঅষ্টমীতে রাজধানীর কোনো মণ্ডপে কুমারী পূজা হচ্ছে না। এর আগে ২০২০ সালেও কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়নি।
বুধবার (১৩ অক্টোবর) রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সকাল নয়টা বাজেই শুরু করা হয় দেবী দুর্গার মহাষ্টমী কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজা। পূণ্যার্থীদের উপস্থিতিতে এদিন সকাল থেকেই সকল মন্দিরে ছিল উৎসবের আমেজ। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা লাইনে পূজার অঞ্জলি নিতে আসা পূণ্যার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল মাস্ক পরা।
মন্দিরের পুরোহিত ধর্মদাশ চট্টোপাধ্যায় সারাবাংলাকে বলেন, আজ দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথি। এ তিথিতে মহামায়ার ষষ্টক অর্থাৎ ৬ বছরের কুমারী রূপ উমার পূজা করা হয়। পৃথিবীতে যেন নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয় এ বার্তাটি দেওয়া হয়ে থাকে এ পূজার মাধ্যমে। তবে এবারও কুমারী পূজার আয়োজন হচ্ছে না।
এবার সকাল আটটা ৫৯ মিনিটে দেবীর মহাষ্টমী কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজা শুরু হয়। মহাঅষ্টমীতে রাত ১১টা ৫৪ মিনিটে সন্ধি পূজা শুরু হবে ও সমাপনী হবে রাত ১২টা ৪২ মিনিটে। অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিক্ষণে এই সন্ধিপূজা অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া এদিন দুপুরে মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হবে।
কুমারী পূজা না হওয়া বিষয়ে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কিশোর রঞ্জন মণ্ডল সারাবাংলাকে বলেন, গত বছরের মতো এবারও রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়নি। মহামারির কারণে মহাঅষ্টমীর দিন এবারও হচ্ছে না কুমারী পূজা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি বলেন, সাধারণত ঢাকায় কুমারী পূজার সময় প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি খুব কঠিন হয়ে যায়। আর ভিড়ের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। সেই ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ঢাকায় কোথাও কুমারী পূজা হচ্ছে না।
এবার ঢাকার বাইরে শুধুমাত্র যশোর রামকৃষ্ণ মঠে কুমারী পূজার আয়োজন হয়েছে বলেও জানান নির্মল কুমার চ্যাটার্জি।
১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ শুরু করেছিলেন বেলুড়মঠের দুর্গাপূজা। সেই বছরই কুমারী পূজার প্রচলন করেছিলেন তিনি। সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বহু বছর আগে নিজের স্ত্রী সারদা দেবীকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় স্বামী বিবেকানন্দ কুমারী পূজার আয়োজন করেন। ১৮৯৬ সালে ঢাকায় রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশে নিয়মিত কুমারী পূজার আয়োজন হয়ে আসছিল।
মেরুতন্ত্রে বলা আছে, সর্বকামনা সিদ্ধির জন্য ব্রাহ্মণ কন্যা, যশোলাভের জন্য ক্ষত্রিয় কন্যা, ধনলাভের জন্য বৈশ্য কন্যা ও পুত্রলাভের জন্য শূদ্রকুল জাত কন্যা কুমারী পূজার জন্য যোগ্য। গুণ ও কর্ম অনুসারেই এই জাতি বা বর্ণ নির্ধারিত হয়। সে জন্যই প্রচলিত শাস্ত্র অনুসারে, বিভিন্ন মিশন ও মন্দিরগুলোতে সর্বমঙ্গলের জন্য ব্রাহ্মণ কন্যাকেই দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়। সব নারীর মধ্যেই বিরাজিত রয়েছে দেবীশক্তি। তবে কুমারী রূপেই মা দুর্গা বিশেষভাবে প্রকটিত হয়েছিলেন। তাই কুমারী রূপে নারীকে দেবীজ্ঞানে সম্মান জানানোর একটি হচ্ছে ‘কুমারী পূজা’।
ভক্তদের বিশ্বাস, যে ত্রিশক্তির বলে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের চক্রে আবর্তিত হচ্ছে, সেই শক্তি বীজ আকারে কুমারীতে নিহিত। সেই বিশ্বাস থেকেই দেবী দুর্গার কুমারীরূপের আরাধনা করেন তারা।
এটি একাধারে ঈশ্বরের উপাসনা, মানববন্দনা এবং নারীর মর্যাদার প্রতিষ্ঠা। নারীর সম্মান, মানুষের সম্মান আর ঈশ্বরের আরাধনাই কুমারী পূজার শিক্ষা।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। আশ্বিন শুক্লপক্ষের এই ১৫টি দিন দেবীপক্ষ, মর্ত্যলোকে উৎসব।
সোমবার (১১ অক্টোবর) সকালে ষষ্ঠী তিথিতে বেলতলায় বিহিতপূজার পর দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। সন্ধ্যায় হয় দেবীর বোধন, অর্থাৎ ঘুম ভাঙানোর আরাধনা।
মঙ্গলবার (১২ অক্টোবর) ছিল দেবী দুর্গার মর্ত্যে আসার দিন, মহাসপ্তমী। মণ্ডপে মণ্ডপে কলাবউ সাজিয়ে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের আরাধনা করেন ভক্তরা, মঙ্গল কামনা করেন নিজের, পরিবারের এবং দেশের জন্য।
বুধবার (১৩ অক্টোবর) মহাঅষ্টমীর দুপুরে মণ্ডপে মণ্ডপে প্রসাদ বিতরণ করা হবে; রাতে হবে সন্ধি পূজা।
বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) বিহিত পূজার মাধ্যমে হবে মহানবমীর আরাধনা।
শারদীয় দুর্গাপূজার এ দিনগুলোর প্রতিটি ক্ষণ মুখরিত হয়ে থাকে পূণ্যার্থীদের নানা রকম আয়োজনে। উৎসবের আমেজে মেতে উঠে ভক্তকূল। নবমীর দিবানিশির প্রহর পেরুলেই উমার কৈলাশ গমন। আর এই ক্ষণ গণনা শুরু হয়ে যায় মহাঅষ্টমী থেকেই। ভক্তকূলের মাঝে বাজে শুধু একটাই সুর— ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ’।
দশমীর বিসর্জনে তাই ভক্তকূল মেতে উঠে একটাই আশা নিয়ে। আরতি ও ঢাকের তালে উমাদেবীকে বিদায়ের ক্ষণে সবারই মনে একটাই চাওয়া— আসছে বছর আবার হবে, মা আসবে ঘরে ঘরে।
সারাবাংলা/এসবি/এএম