‘পরীর পাহাড়’ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই: ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্র
৯ নভেম্বর ২০২১ ১৯:৪৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীর একটি পাহাড়ের নাম কোর্ট হিল নাকি পরীর পাহাড়— এ নিয়ে জেলা প্রশাসন ও আইনজীবী সমিতির বিরোধ যখন তুঙ্গে, তখন ইতিহাসকে সাক্ষী মেনে সেটিকে ‘পরীর পাহাড়’ হিসেবে উল্লেখ করে এ নিয়ে কোনো বিতর্ক না করার আহ্বান জানিয়েছে ‘চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র’। পাহাড়টিকে প্রত্নসম্পদ হিসেবে সংরক্ষণের দাবিও জানিয়েছে সংগঠনটি।
মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে পাঁচ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরীর কেন্দ্রে লালদিঘীর পাড়ের দক্ষিণে সেই পাহাড়, জেলা প্রশাসন যাকে পরীর পাহাড় হিসেবে উল্লেখ করে আসছে। এই পাহাড়ে আছে আদালত ভবন, জেলা আইনজীবী সমিতির বিভিন্ন স্থাপনা এবং বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। আইনজীবীরা সেটিকে অভিহিত করেন কোর্ট হিল হিসেবে।
আরও পড়ুন: জেলা প্রশাসন বনাম আইনজীবী সমিতি, মাঝে ‘পরীর পাহাড়’
সেই পাহাড়ে আদালত সংলগ্ন এলাকায় জেলা আইনজীবী সমিতি সম্প্রতি আইনজীবীদের চেম্বারের জন্য নতুন দু’টি ভবন নির্মাণেরর উদ্যোগ নিলে আপত্তি তোলে জেলা প্রশাসন। সমিতির ওই দুই নতুন স্থাপনা নির্মাণকে জেলা প্রশাসন বলছে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’। আর সমিতির দাবি, নিয়ম মেনে ‘অনুমোদন’ নিয়েই তারা ভবন করছেন। ইতোমধ্যে পাহাড়ে নতুন স্থাপনা নির্মাণ না করতে এবং অবৈধ স্থাপনা অপসারণ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে তাতে সায় দেন প্রধানমন্ত্রী।
এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের পাল্টাপাল্টির পর গত ৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন চট্টগ্রাম আদালতে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক মামলা করেন, যাতে বিবাদি করা হয় জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারকে। মামলায় আইনজীবী সমিতি এই পাহাড়কে সরকারি নথিপত্রে ‘পরীর পাহাড়’ হিসেবে উল্লেখ না করার আবেদন করেন।
এ প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র আয়েজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ১২০ বছর আগে চৌধুরী পূর্ণচন্দ্র তত্ত্বনিধি রচিত চট্টগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থে পরীর পাহাড়ের নামাকরণ ও কাচারি ভবন স্থাপনের ইতিবৃত্ত লিখে গেছেন। পরবর্তী সময়ে সুনীতিভূষণ কানুনগো, আবদুল হক চৌধুরী পরীর পাহাড় নিয়ে বিস্তারিত লিখে গেছেন। গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর গবেষণা মতে, ১৮৯৩ সালে কাছারি স্থাপনের পরও ইংরেজরা পরীর পাহাড়ের নাম পরিবর্তন না করে ইংলিশ অনুবাদে ‘ফেয়ারী হিল’ বলে অভিহিত করত।
চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি আলীউর রহমান বলেন, ‘২০০০ সালে পরীর পাহাড়ের আদালত ভবনকে প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ২১ বছর পরে এসে পরীর পাহাড় নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। প্রত্নসম্পদ আইন অনুযায়ী নান্দনিক কোন স্থাপনার বয়স ৭০ বছর হলে তা প্রত্নসম্পদ হিসাবে বিবেচিত। আমাদের মনে রাখতে হবে- চট্টগ্রামের এই পরীর পাহাড় মহাকবি নবীন চন্দ্র সেন, মাস্টারদা সূর্যসেন ও বিপ্লবী কল্পনা দত্তের স্মৃতি বিজড়িত। এই ভবনের মাস্টারদা সূর্যসেন ও তার সাথীদের বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছিল। এর ঐতিহাসিক মূল্য আছে। সেটা অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী বলেন, ‘শত শত বছরের ইতিহাস পরিবর্তনের অধিকার কারও নেই। পরীর পাহাড় সংরক্ষণে তিন শতাধিক অবৈধ স্থাপনা সরানো জরুরি হয়ে পড়েছে। পাহাড়ের কিনারায় স্থাপিত বহুতল ভবনগুলোর ভূতাত্ত্বিক জরিপ জরুরি। এই ভবনের যেকোনো একটি ধসে পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক, সিডিএ ভবন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। কিংবদন্তির পরীর পাহাড়কে প্রত্নসম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করা না হলে ২০০১ সালের মতো সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে আমরা আন্দোলনে নামব।’
সংগঠনের পক্ষ থেকে উত্থাপিত সুপারিশের মধ্যে আছে- পরীর পাহাড়ের ১৩০ বছরের ঐতিহাসিক স্থাপনা প্রত্নসম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করা। পাহাড়ের চারপাশের স্থাপনা সরিয়ে পুরো শহর থেকে দেখা যায় এমন দর্শনীয় স্থান করে চট্টগ্রামের লাইট হাউজ ঘোষণা করা।
বর্তমান জেলা প্রশাসন থেকে প্রশাসনিক কার্যক্রম সরিয়ে নগরীর বাকলিয়ায় কর্ণফুলী তীরবর্তী এলাকায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি আদালতের কার্যক্রমও পরীর পাহাড় থেকে সরানোর সুপারিশ করা হয়েছে। পাহাড়ের ঢালে নির্মিত ঝুঁকিপূর্ণ সকল ভবন ভেঙ্গে ফেলা এবং ভূতাত্ত্বিক জরিপ করে পুরো পাহাড়ের সকল স্থাপনা সরিয়ে লাল ভবনটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনোজ কুমার দেব, সংগঠক কায়সার আলী চৌধুরী, নির্বাহী সদস্য শ্যামল বিশ্বাস ছিলেন।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম