মালয়েশিয়ায় অভিবাসন হবে কর্মীবান্ধব— থাকছে ক্ষতিপূরণ-পুনর্বাসনও
১৯ ডিসেম্বর ২০২১ ২২:৫৯
ঢাকা: দীর্ঘ চার বছরের বিরতির পর বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য ফের খুলল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের দুয়ার। আনুষ্ঠানিক সমঝোতা স্মারক সইয়ের মাধ্যমে দেশটিতে কর্মী পাঠানোর পথ প্রশস্ত হলো। জানা যাচ্ছে— বৃক্ষরোপণ, কৃষি, উৎপাদন, সেবাখাত, খনি, খনন ও নির্মাণের মতো বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশি কর্মীদের কাজের সুযোগ থাকবে দেশটিতে। আর এসব কর্মী পাঠানো হবে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) অধীন ডাটা ব্যাংক থেকে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবারে মালয়েশিয়ায় নিয়োগ হবে আগের তুলনায় অনেক বেশি কর্মীবান্ধব। নিযুক্ত কোনো কর্মী কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটলে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও পুর্নবাসনসহ ও ক্ষতিপূরণও পাবেন আহত শ্রমিক।
রোববার (১৯ ডিসেম্বর) মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ায় এ সংক্রান্ত সমঝোতা সই হয় রোববার (১৯ ডিসেম্বর)। বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ ও মালয়েশিয়ার পক্ষে দেশটির মানবসম্পদমন্ত্রী দাতুক সেরি এম সারাভানান এই সমঝোতা চুক্তিতে সই করেন।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য দুয়ার খুলে দিলো মালয়েশিয়া
নতুন এ চুক্তিতে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো কর্মীদের মালয়েশিয়া প্রান্তের সব খরচ বহন করবেন নিয়োগকর্তা। এই খরচের মধ্যে থাকছে রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির নিয়োগ, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়ে আসা, আবাসন, কর্মে নিয়োগ এবং কর্মীর নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সব খরচ। পাশাপাশি নিজ খরচে মালয়েশিয়ান রিক্রুটিং এজেন্টও নিযুক্ত করা যাবে।
শুধু তাই নয়, মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর বাংলাদেশি কর্মীর ইমিগ্রেশন ফি, ভিসা ফি, স্বাস্থ্য পরীক্ষার খরচ, ইনস্যুরেন্স সংক্রান্ত খরচ, করোনা পরীক্ষার খরচ, কোয়ারেন্টাইন সংক্রান্ত খরচসহ সব ব্যয়ও মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা/কোম্পানি বহন করবেন। নিয়োগকর্তা কর্মীর মানসম্মত আবাসন, বিমা, চিকিৎসা এবং কল্যাণ নিশ্চিত করবে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, এর ফলে এবারে মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহীদের অভিবাসন খরচ অনেক কমে যাবে।
আরও পড়ুন- মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীর সব খরচ কোম্পানি দেবে
চুক্তিতে আরও থাকছে— মালয়েশিয়ার এমপ্লয়িজ সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ১৯৬৯-এর আওতায় কর্মকালীন দুর্ঘটনা বা কাজের কারণে শারীরিক সমস্যা হলে কর্মী চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ পাবে। ফলে কর্মী বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা, অস্থায়ী অক্ষমতার সুবিধা, স্থায়ী অক্ষমতার সুবিধা, নিরবচ্ছিন্ন উপস্থিতি ভাতা, ডিপেন্ডেন্ট বেনিফিট, পুনর্বাসন সুবিধাসহ মালয়েশিয়ার আইনানুযায়ী প্রাপ্য সুবিধা পাবেন।
এই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে পাঠানো বৈধ রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোর তালিকা থেকে নিয়োগকারী মালয়েশীয় সরকারের বিধি অনুযায়ী বাংলাদেশি এজেন্ট বেছে নেবেন। এ বিষয়ে মালয়েশীয় সরকার স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করবে বলে সমঝোতা স্মারকে উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সমঝোতা স্মারক সইয়ের ফলে পরবর্তী প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদন করে শিগগিরই বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় নতুন কর্মী নিয়োগ শুরু হবে।
আরও পড়ুন- মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ নিয়ে চুক্তি আজ
মধ্যপ্রাচ্যের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। এক সময় বছরে লাখো শ্রমিক যেত দেশটিতে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে প্রতারণা-নির্যাতনের ঘটনায় কর্মী যাওয়া কমতে শুরু করে। কর্মী পাঠাতে অনিয়মের অভিযোগে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে মালয়েশিয়া। দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১২ সালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় জি-টু-জি (সরকারের সঙ্গে সরকার) পদ্ধতিতে কর্মী নিতে রাজি হয় মালয়েশিয়া সরকার। এই উদ্যোগেও লক্ষ্য অনুযায়ী দেশটিতে কর্মী পাঠানো যায়নি। এরপর ২০১৬ সালে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে যুক্ত করে ‘জি-টু-জি প্লাস’ পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগে দুই দেশ একটি সমঝোতা স্মারকে সই করে। সে উদ্যোগও বাস্তবায়ন করতে পারেননি তখনকার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
এরপর অবশ্য ২০১৮ সালে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি সিন্ডিকেট তৈরি করে কর্মী পাঠাতে শুরু করে মালয়েশিয়ায়। ওই সময়ে কর্মী হয়রানির পাশাপাশি অতিরিক্ত অভিবাসন ফি আদায়েরও অভিযোগ ওঠে। আর সে অভিযোগে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই শ্রমবাজার ফের খোলার সুযোগ তৈরি হলো এবারে। তবে এবারেও বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারকদের সংশয়, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী পাঠানো হলে বাজারটি হয়তো পুরোপুরি চালু করা যাবে না। কিংবা চালু করা গেলেও সেখানে অভিবাসন ব্যয় কম রাখা নিয়ে সংশয় জানিয়েছেন তারা।
আরও পড়ুন- মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান মন্ত্রীর
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, আগের চুক্তিগুলোতেও এমন বিষয় উল্লেখ করা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিণতি কী হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছেন। এবারও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আমরা বলেছি। সরকারও বলেছে সিন্ডিকেট থাকবে না। কিন্তু সমঝোতা স্মারকে সে বিষয়টি নেই। এখন যদি সেই সিন্ডিকেট ধরেই কর্মী পাঠাতে হয়, তাহলে অভিবাসন ব্যয় কোনোভাবেই কমানো সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করা হলে সেখানকার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দুই দিক থেকেই বড় শক্তি কাজ করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম না। এখানে কাজের সুযোগ কর্মীর চাহিদা থাকায় অভিবাসন ব্যয় তো কর্মীরাই দিতে চান। সেক্ষেত্রে চাইলেও অভিবাসন ব্যয় কমানো কঠিন হয়ে যাবে, যা এর আগেও ঘটেছে।
আরও পড়ুন- খুলছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চুক্তি ডিসেম্বরেই
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, এবারও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে মরিয়া একটি চক্র। এরমধ্যে তারা সিন্ডিকেট তৈরির একটি তালিকাও নীতি নির্ধারকদের কাছে পাঠিয়েছে। জানা যায়, এমন ঘটনা ২০১৬ সালেও ঘটেছিল। তখন মাত্র ১০টি বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি নির্বাচন করা হয়। ওই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যাওয়া একেকজন কর্মীকে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে।
এবারে অবশ্য প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় আশাবাদী, কম অভিবাসন খরচেই নিরাপদ ও সুরক্ষিতভাবে কর্মীদের মালয়েশিয়া পাঠানো সম্ভব হবে। সমঝোতা স্মারকেও মিলেছে তারই ইঙ্গিত। এবারে সেই সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়নের পালা।
সারাবাংলা/জেআর/টিআর
কর্মবাবান্ধব অভিবাসন বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সমঝোতা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার শ্রমবাজার উন্মোচন সমঝোতা স্মারক