Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইসি’র হারানো ল্যাপটপে ভোটার, এনআইডিও পান শাহ আলী

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৮ জানুয়ারি ২০২২ ২০:৪৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: সাত বছর আগে রহস্যজনকভাবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হারিয়ে যাওয়া একটি ল্যাপটপ থেকে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষকে অবৈধভাবে ভোটার করার তথ্য পেয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেই অবৈধ ভোটারদের অধিকাংশই মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা। সেই অর্ধলক্ষ ভোটারের একজন হিসেবে অবৈধভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পেয়েছিলেন মিয়ানমারের নিষিদ্ধ ঘোষিত সশস্ত্র সংগঠন আরসা প্রধান আতাউল্লাহর ‘ভাই’ শাহ আলী। অবৈধ এ কাজে নির্বাচন কমিশনেরই কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকার তথ্য পেয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিল দুদক।

বিজ্ঞাপন

গত রোববার (১৬ জানুয়ারি) ভোরে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নৌকার মাঠ সংলগ্ন এলাকা থেকে অস্ত্র ও মাদকসহ শাহ আলীকে (৫৫) গ্রেফতার করে ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের (এপিবিএন) সদস্যরা। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানার ২০ নম্বর দেওয়ানবাজার ওয়ার্ডের জয়নাব কলোনির ঠিকানা ব্যবহার করে এনআইডি নিয়েছিলেন শাহ আলী। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নম্বর— ১৯৭১১৫৯৪ ১২০০০০০১৮।

বিজ্ঞাপন

কীভাবে শাহ আলী পেয়েছিলেন বাংলাদেশের এনআইডি? প্রাথমিক অনুসন্ধান করে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে চিহ্নিত কর্মচারীদের যে চক্রটি অবৈধভাবে বেশ কয়েকজনকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এনআইডি সরবরাহ করেছিল, সেই চক্রকে ব্যবহার করেই শাহ আলীও পেয়েছেন এনআইডি। তিন বছর আগেই নির্বাচন কমিশনের একটি তদন্ত দল অবৈধভাবে এনআইডি পাওয়া বেশকিছু নম্বর শনাক্ত করেছিল, সেখানে একটি নম্বর শাহ আলীর।

নির্বাচন কর্মকর্তারা এ-ও বলছেন, তিন বছর আগেই শনাক্তের পর শাহ আলীর এনআইডি নম্বর সার্ভারে ‘ব্লক’ করে দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে ওই এনআইডি নম্বর বৈধভাবে ব্যবহারের কোনো সুযোগ তার ছিল না। তবে আরসা প্রধানের ভাই হিসেবে শাহ আলীকে পুলিশ শনাক্ত করার পর তার ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি ও এনআইডি সংগ্রহের বিষয়টি নিয়ে জোর আলোচনা চলছে।

আরও পড়ুন-

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘শাহ আলীর যে এনআইডি নম্বর পাওয়া গেছে, সেটি আমরা নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে চেক করে দেখেছি। সার্ভারে এনআইডি নম্বরটি লক করা আছে। কেন সেটি লক করা হয়েছে, সেটি এনআইডি উইং ভালো বলতে পারবে। তবে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে বলেই সেটি লক করা হয়েছে। আর লক আছে মানে এর কোনো কার্যকারিতা আর নেই। কীভাবে সে এনআইডি পেল, সেটা পুলিশ নিশ্চয় তদন্ত করে বের করবে।’

রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ও এনআইডি সরবরাহ করা নিয়ে ২০২১ সালের জুন মাসে চট্টগ্রামে চারটি মামলা করেছিল দুদক। এর মধ্যে ১৬ জুন দায়ের করা এক মামলায় বলা হয়, ২০১৫ সালে নির্বাচন কমিশনের খোয়া যাওয়া একটিসহ কয়েকটি ল্যাপটপ ব্যবহার ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা এবং তারা এনআইডিও পেয়েছেন।

২০১৯ সালে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা নিয়ে জালিয়াতির বিষয় গণমাধ্যমে উঠে এলে পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনের তৎপরতায় ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের কর্মচারী জয়নাল আবেদীনের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়। নির্বাচন কমিশনের হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটিই সেই ল্যাপটপ কি না, তা নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়ার কথা বলেছিল দুদক।

মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন ওই সময় বলেছিলেন, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার করা হয়েছিল। তাদের অনেককে এনআইডিও দেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে কয়েকজন বাঙালি ছাড়া সবাই রোহিঙ্গা।

এপিবিএনের হাতে গ্রেফতার শাহ আলী

শাহ আলীর বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৯ সালে বেশকিছু রোহিঙ্গাকে ভোটার করার অভিযোগে কয়েকজন কর্মচারীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তখন নির্বাচন কমিশন থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি ২০১৯ সালেই বেশকিছু অবৈধ এনআইডি নম্বর শনাক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল। ওই বছরই এনআইডি নম্বরগুলো ব্লক করে দেওয়া হয়। আমরা মিলিয়ে দেখেছি, সেখানে শাহ আলীর নম্বরও আছে।’

‘আমরা শতভাগ নিশ্চিত করে বলতে পারি, শাহ আলী কিংবা অবৈধ রোহিঙ্গা ভোটার— এরা কেউই নির্বাচন কার্যালয়ে এসে ভোটার হননি, এনআইডিও পাননি। বাইরে থেকে জালিয়াত চক্র অবৈধভাবে তাদের ভোটার করেছিল ও এনআইডি পাইয়ে দিয়েছিল এবং সেটি ২০১৯ সালের মধ্যেই। কোনোভাবেই এরপরে নয়। কারণ তখনই বিষয়টি ধরা পড়ার পর এনআইডি নম্বরগুলো ব্লক করা হয়েছিল। সুতরাং সেই এনআইডির ডাটা বাইরে থেকে অ্যাকটিভ করার সুযোগ নেই। আবার সেই এনআইডি ব্যবহার করে বৈধ কোনো সুবিধা নেওয়ারও সুযোগ নেই,’— বলেন কামরুল ইসলাম।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের চট্টগ্রামের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোতোয়ালি এলাকার ঠিকানা ব্যবহার করে যাদের অবৈধভাবে ভোটার করা হয়েছে ও এনআইডি পাইয়ে দেওয়া হয়েছে, এর সবগুলোই করেছেন নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন। তার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ল্যাপটপটিই খোয়া যাওয়া ল্যাপটপ বলে আমরা প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণে নিশ্চিত হয়েছিলাম। শাহ আলী যেহেতু কোতোয়ালি থানা এলাকার ঠিকানা ব্যবহার করেছে, তাহলে জয়নালের ল্যাপটপের মাধ্যমেই তাকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এনআইডি সরবরাহ করা হয়েছিল।’

শাহ আলীর এনআইডিতে দেওয়ানবাজার ওয়ার্ডের যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে, সেই জয়নাব কলোনির মালিক মোহাম্মদ নুরুদ্দিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কলোনিতে তিনটি ভবন আছে। প্রায় ১৯০০ ভোটারের বসবাস। আমি শাহ আলী নামে কাউকে কখনো ভাড়া দিইনি। আমার ভাড়াটিয়া অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের। শাহ আলীর ছবি আমি দেখেছি। তাকে আমি চিনিও না। জালিয়াতি করে জয়নাব কলোনির ঠিকানা ব্যবহার করে সে ভোটার হয়েছে।’

এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেফতার ৩ ইসি কর্মী

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘শাহ আলী আদৌ চট্টগ্রামের বাসিন্দা নন কিংবা চট্টগ্রামে কখনো ছিলেন না। ভোটার হতে হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সনদ জমা দিতে হয়। এক্ষেত্রে কারও গাফিলতি ছিল কি না, সেটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তার বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় মামলা হয়েছে। উখিয়া থানা যদি এনকোয়ারি স্লিপ পাঠায়, তাহলে আমরাও বিষয়টি তদন্ত করে দেখব।’

চসিকের দেওয়ানবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসান মাহমুদ হাসনী সাংবাদিকদের বলেন, ‘শাহ আলী নামে কেউ আমার দেওয়ান বাজার ওয়ার্ডের ভোটার তালিকায় নেই। এই নামে আমি কোনো জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয়তা সনদও দিইনি। নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নালের বাসা আমার ওয়ার্ডের পাশে জামালখান ওয়ার্ডের আমেনা মঞ্জিলে। জয়নাল বাসায় বসে অবৈধভাবে সার্ভারে প্রবেশ করে এই জালিয়াতি করেছে।’

চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় অবৈধভাবে ভোটার হওয়া ও জালিয়াতি করে এনআইডি পাওয়ার একটি ঘটনা ধরা পড়লে ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদিনসহ তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়।  জয়নালসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের হয়, যা তদন্ত করছে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।

জবানবন্দিতে জয়নালের তথ্যে গ্রেফতার করা হয় ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম-২০১৯ প্রকল্পে যুক্ত টেকনিক্যাল সাপোর্ট কর্মী মো. মোস্তফা ফারুককে। জয়নাল জালিয়াতির তথ্য স্বীকার করে এর সঙ্গে যুক্ত আরও ১৬ জনের নাম প্রকাশ করে। মোস্তফা ফারুক প্রকাশ করে আরও অন্তত ১২ জনের নাম।

আরও পড়ুন-

তবে শুরুতে মামলার তদন্ত জোরেশারে চললেও মাস দুয়েকের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে যায়। জয়নাল, মোস্তফা ফারুকসহ গ্রেফতার প্রায় সবাই জামিনে বেরিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।

ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক সঞ্জয় কুমার সিনহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মোট ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছিলাম। নির্বাচন কমিশনের কাছে তদন্তের প্রয়োজনে কিছু নথিপত্র চেয়ে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু সেই নথিপত্রগুলো দীর্ঘ সময়েও আমরা পাইনি। এজন্য মামলার তদন্ত আগানো যাচ্ছে না। তবে দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের চেষ্টা আমরা করছি।’

একইভাবে ২০২১ সালের জুনে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা এ সংক্রান্তে চারটি মামলার অভিযোগপত্রও গত সাত মাসে দাখিল হয়নি। এ বিষয়ে দুদকের সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা মুখ খুলতে রাজি হননি।

জানতে চাইলে দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক মাহমুদ হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি কোভিড আক্রান্ত। সুস্থ হয়ে অফিসে গিয়ে এ বিষয়ে খোঁজখবর নেব।’

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

আরসা প্রধানের ভাই শাহ আলী এনআইডি জালিয়াতি দুদক নির্বাচন কমিশন রোহিঙ্গাদের হাতে এনআইডি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর