২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৭৮০৯ জন: যাত্রী কল্যাণ সমিতি
২৩ জানুয়ারি ২০২২ ২১:১৩
ঢাকা: গত বছর ৫ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন নিহত এবং ৯ হাজার ৩৯ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া রেলপথে ৪০২টি দুর্ঘটনায় ৩৯৬ জন নিহত, ১৩৪ জন আহত হয়েছেন এবং নৌ-পথে ১৮২টি দুর্ঘটনায় ৩১১ জন নিহত ও ৫৭৮ জন আহত হয়েছেন, নিখোঁজ হয়েছেন ৫৪৪ জন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
রোববার (২৩ জানুয়ারি) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী তাদের এই বার্ষিক এই প্রতিবেদন তুলে ধরেন।
দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক সংবাদপত্র ও অনলাইন নিউজপোর্টালে প্রকাশিত দুর্ঘটনার সংবাদ পর্যালোচনা করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
মোজাম্মেল হক জানান, সড়ক, রেল, নৌ-পথে সর্বমোট ৬ হাজার ২১৩টি দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫১৬ জন নিহত এবং ৯ হাজার ৭৫১ জন আহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৩৫০ জন চালক, ১ হাজার ৭১৫ জন পথচারী, ১ হাজার ১৭ জন পরিবহন শ্রমিক, ৪৩০ জন ছাত্র-ছাত্রী, ১১১ জন শিক্ষক, ২৩৭ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, এক হাজার ৭৬ জন নারী, ৬৩৮ জন শিশু, ৪২ জন সাংবাদিক, ২৭ জন চিকিৎসক, ১৪ জন আইনজীবী ও ১৮ জন প্রকৌশলী এবং ১৬১ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা। হতাহতদের ৭৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ ১৫ থেকে ৪৫ বছরের কর্মক্ষম ব্যক্তি এবং নারী।
দুর্ঘটনায় পড়া ৭ হাজার ৭৩০টি যানবাহনের তথ্য গণমাধ্যমে পাওয়া গেছে, যার ৩০ দশমিক ৪২ শতাংশ ট্রাক, পিকআপ, লরি ও কাভার্ডভ্যান, ২৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ বাস, ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ নছিমন, করিমন ট্রাক্টর ও লেগুনা, ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ অটোরিকশা, ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা, রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক, ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ কার, জিপ ও মাইক্রোবাস- জানান মোজাম্মেল হক।
তিনি জানান, মোট দুর্ঘটনার ৫৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা। ২২ দশমিক ১৭ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৬ দশমিক ১৩ শতাংশ খাদে পড়ে, ৬ দশমিক ২১ শতাংশ বিভিন্ন কারণে, শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে এবং শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়া, ট্রেন যানবাহন সংঘর্ষ, মুখোমুখি সংঘর্ষ, চাকায় ওড়না পেঁচিয়ের নিহতের ঘটনা বেড়েছে। তবে নিয়ন্ত্রণ হায়িয়ে খাদে পড়ার ঘটনা ও অন্যান্য দুর্ঘটনা কমেছে।
মোজাম্মেল হক বলেন, ২০২১ এ মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩৯ দশমিক ২৯ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২০ দশমিক ৩৪ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘প্রায় ৩ মাস গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও ২০২১ সালে জাতীয় মহাসড়কে দুর্ঘটনা আগের বছরের চেয়ে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ, ফিডার রোডে এক দশমিক ২৩ শতাংশ, রেলক্রসিং এ শূন্য দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ বেড়েছে। তবে আঞ্চলিক মহাসড়কে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে।’
দুর্ঘটনার কারণ উল্লেখ করে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগকে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।’
এছাড়া সড়কে ছোট যানবাহন বৃদ্ধি, চাঁদাবাজি, রাস্তার পাশে হাট-বাজার, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় নামানো এবং দেশব্যাপী নিরাপদ ও আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থার পরিবর্তে টুকটুকি-ইজিবাইক-ব্যাটাররিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা নির্ভর গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়ার কারনে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব।
সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- সড়ক নিরাপত্তায় বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়ন, আইনের ত্রুটি চিহ্নিত ও সংস্কার করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন, সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো, সড়ক মন্ত্রণালয়ে আলাদা সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট গঠন, সড়ক নিরাপত্তায় ইত্যিমধ্যে প্রণীত যাবতীয় সুপারিশমালা বাস্তবায়ন উদ্যোগ নেওয়া, দেশের সড়ক-মহাসড়কে রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা, জেব্রা ক্রসিং দেওয়া, গণপরিবহন চালকদের পেশাদার ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, সড়ক পরিবহন সেক্টরে অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাদাঁবাজি বন্ধ করা, গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করা, সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠন করে হতাহতদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, দেশব্যাপী চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন গণপরিবহন নামানোর উদ্যোগ নেওয়া, ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং একাডেমি গড়ে তোলা এবং গণপরিবহনে সেবা ও নিরাপত্তার মান পর্যবেক্ষণের জন্য দেশের সকল মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, জেলা প্রশাসকদের প্রতিমাসে একদিন পরিচয় গোপন রেখে গণপরিবহন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক হাদিউজ্জামান, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আবদুল হক ও মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম