হিমেলের নামে ভবন নিয়ে বিতর্ক কেন?
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১০:৪১
রাবি: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ট্রাক চাপায় নিহত শিক্ষার্থী হিমেলের নামে বিজ্ঞান ভবনের নামকরণ নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা ও সমালোচনা। এই বিতর্ক এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরা পাল্টাপাল্টি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কেন এই বিতর্ক? তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
এর আগে গত ১ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯ টায় ট্রাকের চাপায় গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব হিমেল নিহত হন। নিহতের পরেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল হয়ে পড়ে পুরো ক্যাম্পাস। এরপর দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকটি দাবি মেনে নিয়ে নির্মাণাধীন বিজ্ঞান ভবনটির নামকরণ শহীদ হিমেলের নামে করবেন বলে আশ্বাস দেন। এতে বর্তমান প্রশাসনকে নিয়ে চারদিকে বইতে শুরু করে প্রশংসার জোয়ার। কিন্তু হিমেলের মৃত্যুর ৭ দিনের মাথায় গত সোমবার (৭ ফেব্রুয়ারি) ভবনটির নামফলক ‘মাহবুব হাবিব হিমেল একাডেমিক ভবন’ লাগায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এরপর থেকেই শুরু হয় বিতর্ক। একটি পক্ষ হিমেলের নামফলক লাগানোকে যৌক্তিক দাবি করলেও আরেকদল এটিকে নিয়ে তুলেছেন প্রশ্ন।
আরও পড়ুন: হিমেলের মৃত্যু: শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নিলেন রাবি ভিসি
হিমেলের নামে একাডেমি ভবন ও রাস্তার নামকরণ হবে: রাবি উপাচার্য
মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ নামের এক শিক্ষার্থী তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘শহীদ হিমেলের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, আমি মনে করি, রাবি’র নির্মাণাধীন ২০তলা বিজ্ঞান ভবনটি উপমহাদেশের বিখ্যাত গণিতবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের নামে হওয়া উচিত। বিজ্ঞানে অবদান আছে এরকম জগৎ বিখ্যাত মানুষের নামে বিজ্ঞান ভবনের নাম হওয়া উচিত।’
আরিফ রায়হান মুন নামে আরেক এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘যে ভবন বানাতে গিয়ে ট্রাক চালকের জন্য একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ পিষ্ট হয়ে ঝড়ে গেল, সেই হিমেলের নামে যখন ভবনটির নামকরণের প্রস্তাব উঠল তখন উপাচার্যের সঙ্গে সংলাপে কেউ এর বিরোধিতা করল না। অথচ আজ ভবনের নাম যেন হিমেলের নামে না হয় তার জন্য যুক্তিতর্কের অভাব হচ্ছে না। বর্তমান থেকে শুরু করে সাবেক শিক্ষার্থীরাও এর বিরোধিতা করছেন। কিন্তু কেন?’
আরও পড়ুন: রাবি শিক্ষার্থী হিমেলের দাফন হলো নানা বাড়িতে
রাবি শিক্ষার্থীর নিহতের ঘটনায় ট্রাক চালক আটক
তিনি আরও লিখেছেন, ‘হিমেলের নামে না হয়ে অন্য কোনো মনীষীর নামে নামকরণ করলে কি বিরাট উপকার হবে কেউ বলবেন? এর আগে যখন ৪টা বিজ্ঞান ভবনের নাম শুধু ১-৪ এর মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল তখন তো এগুলোর নামকরণ নিয়ে কোনো বুদ্ধিজীবীকে লাফাতে দেখিনি। আর এখন তো আপনারা পারলে বর্তমান- সাবেকদের নিয়ে আন্দোলন কমিটি করে হিমেলের নাম সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আপনাদের সমস্যাটা কোথায়? একবার বলবেন? বরং হিমেলের নামে ভবনটির নামকরণ হলে সারাদেশে আলোড়ন তৈরি হবে।’
এদিকে তৌহিদ ইসলাম বিপুল নামের এক সাবেক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ ও সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীর জীবনের কাছে ভবনের নামকরণও আমার কাছে নগন্যই মনে হয়।’
কেন হঠাৎ করে স্মৃতিফলক লাগানো হলো- এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাকসু আন্দোলন মঞ্চের সমন্বয়ক আবদুল মজিদ অন্তর বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমাদের একজন শিক্ষার্থী তার জীবন দিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমরা ভবনটির নামকরণ যেন তার নামেই হয় সে দাবিই জানিয়েছি। তারা একমত হয়েছে। আমরা চাই ভবিষ্যতে যখন ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হবে তখন যেন তার নামেই নামকরণ করা হয়। সেজন্য আমরা তার স্মৃতি ধরে রাখতে তার নামেই নামকরণ করেছি।’
আরও পড়ুন: রাবিতে ট্রাকচাপায় ছাত্র নিহত, ড্রাইভার ও হেলপারের বিরুদ্ধে মামলা
রাবিতে ট্রাকচাপায় শিক্ষার্থীর মৃত্যু, ৪ ট্রাকে আগুন
হিমেলের বিভাগের সহপাঠী মিঠুন চন্দ্র মহন্ত বলেন, একজন শিক্ষার্থীর জীবন এই ভবনের অব্যবস্থাপনার কারণে এই ভবনের সামনে ঝড়ে গেছে। আমরা দাবি জানিয়েছিলাম সেই শিক্ষার্থী হিমেলের নামে এই ভবনের নামকরণ করতে হবে। পরবর্তীতে ভিসি স্যারসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের আশ্বাস দেয় তারা হিমেলের নামেই এই ভবনের নামকরণ করবেন। আমরা মনে করি, এই দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া অবধি আমাদের দাবি স্পষ্টভাবে আরও দৃশ্যমান থাকুক। এটা কেবল একটা সাইনবোর্ড নয় এটা আমাদের ভালেবাসা, আবেগ ও দাবির বহিঃপ্রকাশ। দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া অবধি এই ভবনের নামকরণের সাইনবোর্ডটা আমাদের দাবিকে আরও জোরদার রাখবে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময় সড়কে অনেক জীবন ঝড়ে যায়। কিন্তু আমার তার দৃশ্যমান কোনো শাস্তি আমরা দেখি না। এই অব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত কবার দাবি জানাই। পাশাপাশি হিমেলের পরিবারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তা কেবলই আশ্বাস না হয়ে বাস্তবায়িত যেন হয় আমরা এটা চাই।
ভবনের নামকরণে কোনো ধরনের নিয়ম মেনে চলা বাধ্যতামূলক কি না জানতে চাইলে- দ্য ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স টোয়াসের সদস্য ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলো সাধারণত বিজ্ঞানে যারা অবদান রাখেন এমন সব ব্যক্তিদের নামে হয়ে থাকে। তবে এ বিষয়ে ধরাবাধা কোনো নিয়ম নেই।
আরও পড়ুন: হিমেল স্মরণে রাবিতে ৪ দিনব্যাপী আর্ট ক্যাম্প
হিমেলের স্মরণে রাবিতে জ্বলল শত মোমের আলো
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশের আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে ভবনের নামকরণ করা যাবে। হিমেলের নামে নামকরণের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে কোনো ধরনের বাধা আছে কি না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সত্যি বলতে আমাদের একজন শিক্ষার্থী এভাবে চলে গেছে এতে আমরা সবাই আবেগ আপ্লুত। সিন্ডিকেট একমত হলে নামকরণে কোনো বাধা নেই। তবে, ভবনের নামকরণ অনেকদিন পরের বিষয়। ততদিন পরে এই নামটি পাশ হয় কি না তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই অধ্যাপক।
এদিকে হিমেলের নিহতের পরের দিন বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাশ বাংলাদেশ চত্বরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপকালে নিহত হিমেলের নামের ভবনটির নামকরণের আশ্বাস দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার।
এ সময় উপাচার্য বলেন, ‘আমরা হিমেলের নামেই বিজ্ঞানভবনটির নামকরণ করব। আর তার স্মরণে চিরস্থায়ী একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করব।’
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯ টার দিকে নির্মাণাধীন বিজ্ঞান ভবনের সামনে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব হিমেল নিহত হয়। সেই সময় কয়েক দফা দাবির মধ্যে নির্মাণাধীন ওই বিজ্ঞান ভবনের নাম নিহত হিমেলের নামে করার শর্ত দেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যা মেনে নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সারাবাংলা/এনএস