ভীতির সংস্কৃতি তৈরি করে কথা বলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে: আনু মুহাম্মদ
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২৩:২৪
ঢাকা: দেশে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে কোনো স্বচ্ছতা নেই অভিযোগ করে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, এসব কাজে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে ভাবে না বরং মুনাফার চিন্তা করে। এদিকে প্রকল্প ব্যয় বেড়েই যাচ্ছে— যার ভার টানতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এসব চাপা দিতে একধরনের ভীতির সংস্কৃতি তৈরি করে কথা বলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মানুষ ও প্রকৃতির স্বার্থ রক্ষা করতে সবাইকে সরব হতে হবে।
চলমান বাপা-বেন সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের অপরাহ্নের অধিবেশনে এ কথা বলেন তিনি। ‘উচ্চ দুর্যোগের সঙ্গে উচ্চ প্রবৃদ্ধি: বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের সময়ে টেকসই উন্নয়নের সমস্যা’ শিরোনামের আলোচনায় তিনি এ সব কথা বলেন।
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘উন্নয়নের জন্য প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ ধ্বংস করা জরুরি না। এর আরও পথ আছে। বাংলাদেশে বর্তমান উচ্চ প্রবৃদ্ধির যে অর্থনীতি তার ফলে পরিবেশ ও মানুষের জীবন নানা হুমকির সম্মুখীন। তাই উন্নয়নের এ ধারা পরিহার করে টেকসই উন্নয়নের পথে আসতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে সবচাইতে বিপদগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। এখন বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি থেকে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবে ও এই বিপদের মধ্যেই কীভাবে নিজেকে সমৃদ্ধ করবে সেই প্রশ্ন অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন বাংলাদেশ যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে আমরা পরস্পরবিরোধী দুটি বিষয় দেখছি। যা টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে মেলে না এর মধ্যে একটি হল উচ্চ প্রবৃদ্ধি যা গত কয়েক বছর ধরে দেখতে পাচ্ছি। গত দুই দশক ধরেই প্রবৃদ্ধি উচ্চই ছিল। গত এক দশকে সেটি আরও বেশি।এই অর্জনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রচুর প্রশংসা কুড়াচ্ছে। একে বাংলাদেশের একটি সাফল্য হিসেবে দেখানো হচ্ছে। পাশাপাশি জাতীয়-আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমীক্ষায় আমরা এটিও দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশ বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে। ধনী বৃদ্ধির হারেও বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে। আবার বৈষম্য বৃদ্ধির মধ্যেও বাংলাদেশ প্রথম অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের দারিদ্র এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যে ভালনারিবিলিটি, শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে নাজুক অবস্থা সেসব ক্ষেত্রে একটি জটিল অবস্থার মধ্যে আছে বাংলাদেশ। সহিংসতা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মানানসই অবস্থা দেখা যাচ্ছে না।’
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘জিডিপির গ্রোথ নানাভাবে হতে পারে। নদী ভরাট করে বাড়ি বানানো হলে, পাহাড় কেটে আবাসন বানালে বা সুন্দরবন ধ্বংস করে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বানালে, খোলা জায়গা দখল করে স্থাপনা বানালে, কক্সবাজারের ইকোলজিক্যাল এলাকায় স্থাপনা বানালে কেনাকাটা-নির্মাণ কাজ হলে সেটির ফলে জিডিপি বাড়বে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি হিসাব করলে ইকুয়েশোনের একটি দিক দেখা হয়। শুধু দেখা যায় জিডিপি বাড়ছে কিন্তু কিসের বিনিময়ে বাড়ছে, কোন মূল্য দিয়ে বাড়ছে, এর বিনিময়ে কী ক্ষতি হচ্ছে সেই ক্ষতিটা বেশি নাকি লাভটা বেশি তা জিডিপির হিসেবের মধ্যে আসে না। তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের বড় বড় অর্থনীতিবিদরা এখন জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করতে চান না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর বয়সেও আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের জাতীয় বিদ্যুৎ নীতি ঠিক করছে জাপানের জাইকা নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের যারাই এসব মহাপরিকল্পনা করছেন তারা জাপানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি। অনেকেই আবার জাপানি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। এভাবে গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ নীতি ঠিক করার মতো কোনো ব্যক্তি তৈরি হয়নি। এভাবে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। শুধু বিদ্যুৎ নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। এভাবে দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে দেশি-বিদেশি কিছু ব্যাবসায়িক গোষ্ঠী। যারা জনগণের চেয়ে মুনাফাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এসব কারণেই কোনো কিছুর মধ্যে কোনো স্বচ্ছতা নাই।’
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘যা কিছু নির্মাণ হচ্ছে, যত প্রকল্প হচ্ছে সেখানে জনসম্পৃক্ততা নেই। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে যেমন কিছুই জানা যায় না। শুধু আমরা জানি এটি একটি জাতীয় গর্ব। এভাবে অন্যান্য অনেকগুলো পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও এমনটিই দেখেছি। রূপপুর, মাতারবাড়ি ইত্যাদি প্রকল্প সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট ও পরিষ্কার তথ্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে নেই। এর পরিবেশগত ও মানবিক ক্ষতি কত সেটি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভয়াবহ চিত্র আমাদের সামনে আছে। অথচ জনগণের সম্মতি ও অনুমোদন টেকসই উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। এতে দেখা যাচ্ছে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। যার বোঝা মানুষের ওপর আসছে। এর ফলেই ডিজেল, তেল, গ্যাসের দাম বেড়ে যাচ্ছে, পানির দাম বাড়ছে কিন্তু ওয়াসার পানির কোয়ালিটি বাড়ছে না, মানুষের জীবনযাত্রা ব্যয় বাড়ছে। কিছু মানুষ বিপুল সংখ্যক সম্পদের মালিক হচ্ছে।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘২০১৭ সালে আমরা সরকারের কাছে বিকল্প উন্নয়নের একটি মহাপরিকল্পনা দিয়েছি। সেখানে আমরা দেখিয়েছিলাম রামপাল, রূপপুরের মতো প্রকল্পের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিশ্বব্যাংকীয় চিন্তাভাবনা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দিয়ে হবে না, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লাগবে সেই পথ অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা পরিবেশ ধ্বংস করছি। দেশে চলমান পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রমে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। রামপালে আছে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, রূপপুরে আছে রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান। এভাবে লাভজনক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নরওয়ে, চীনসহ নানাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা ব্যবসা করছে। এভাবে জাতীয় সক্ষমতা না বাড়িয়ে বিদেশি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাজ করিয়ে মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে না। তাই টেকসই উন্নয়ন করতে চাইলে সরকারের নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। গণহারে বেসরকারিকরণ, লাভের চিন্তার অর্থনীতি থেকে সরে আসতে হবে।’
সারাবাংলা/আরএফ/একে