নারী দিবসের সমাবেশে সম্পদ-সম্পত্তিতে সমান অধিকারসহ ২০ দাবি
৮ মার্চ ২০২২ ২২:৫৫
ঢাকা: আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ৬৬টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশ থেকে সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকারের দাবি উঠে এসেছে। নারীর সাংবিধানিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে সমাবেশ থেকে ২০টি দাবি তুলে ধরা হয়েছে।
মঙ্গলবার (৮ মার্চ) বিকেল ৩টায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে ‘নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ করো, সম্পদ- সম্পত্তিতে সমান অধিকার ও সমঅংশীদারিত্ব নিশ্চিত করো’ স্লোগানকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু হয়ে সমাবেশের পর একটি র্যালি শহিদ মিনার চত্বর থেকে শুরু হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে গিয়ে শেষ হয়।
‘নারী-পুরুষের সমতা, টেকসই আগামীর মূলকথা’ প্রতিপাদ্যের আলোকে এই আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই আয়োজন শুরু হয়। ওয়াইডাব্লিউসিএ’র উপাধ্যক্ষ ফ্লোরেন্স গোমেজের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন নবনীতা চৌধুরী ও ছায়া কর্মকার। নৃত্য পরিবেশন করে শিশু শিল্পী অংকিতা সাহা। এছাড়াও আবৃত্তি সংগঠন পঞ্চকন্যার পাঁচ আবৃত্তিশিল্পী শারমিন লাকি, তামান্না তিথি, নাজনীন নাজ, বুশরা তিথি ও হাবিবা হ্যাপি আবৃত্তি শোনান।
সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা দূর করে নারী-পুরুষের সমতার দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই সমতা আমাদের এক নতুন সমাজ উপহার দিতে পারবে।
নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমন আরা হক মিনু বলেন, শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও নারী এখনো নানা ক্ষেত্রে বঞ্চিত। সমান অধিকার তো দূরের কথা, এখনো মৌলিক মানবাধিকার থেকেও নারীরা বঞ্চিত। শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই প্রেক্ষাপটে এখনো নারী দিবস উদযাপন সমান প্রাসঙ্গিক।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে সমাবেশে ঘোষণা পাঠ করেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার রেহেনা বেগম। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে নারীর অবদানে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক খাতের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে নারী ও কন্যাশিশুরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক সহিংসতাসহ বিভিন্ন দ্বন্দ্বের কারণে ধর্ষণসহ বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হচ্ছে। নারীর প্রতি এই বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ করে, সম্পদ-সম্পত্তিতে সমান অধিকার ও সমঅংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
সমাবেশে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির পক্ষ থেকে ২০ দফা দাবিও তুলে ধরেন রেহেনা বেগম। দাবিগুলো হলো—
১. সংবিধানে প্রদত্ত সমঅধিকার বাস্তবায়নের জন্য আইনি পদক্ষেপে নিতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে;
২. সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার ও সমঅংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে;
৩. নারী ও কন্যার প্রতি নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ করতে হবে। দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে;
৪. হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী ঘটনাস্থলকে মুখ্য বিবেচনা না করে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মতো আমলযোগ্য অপরাধের ঘটনায় কোনো বৈষম্য, বিলম্ব ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে থানায় অভিযোগ নিতে হবে;
৫. অপরাধীকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে পাড়া-মহল্লায় গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে;
৬. মাদকব্যবসা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে;
৭. ধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে করতে হবে;
৮. উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন নিপীড়ন বন্ধে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন ও রায়ের আলোকে আইন প্রণয়ন করতে হবে;
৯. পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ বাস্তবায়ন করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নারীকে অবমাননা করে— এমন প্রতিবেদনের প্রকাশ/প্রচার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে;
১০. ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারি (মেডিকো-লিগ্যাল) পরীক্ষার ক্ষেত্রে ‘টু ফিংগার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন করতে হবে;
১১. ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া চলবে না;
১২. অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তা, অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে;
১৩. করোনাকালীন ও করোনা পরবর্তী সময়কে বিবেচনায় নিয়ে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ আরও জোরদার করতে হবে;
১৪. বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন পরিবর্তন করে সব নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অভিন্ন পারিবারিক আইন চালু করতে হবে (বিয়ে ও বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব, দত্তক, সম্পত্তির উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে);
১৫. নারী গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে বিষয়টিকে শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে;
১৬. গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে হবে;
১৭. ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী অধিকার ও সুরক্ষা আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে;
১৮. ধর্ষণের শিকার বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী নারীর আইনি সহায়তার ক্ষেত্রে ইশারা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে;
১৯. বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৭-এর কন্যার বিয়ের বয়স সংক্রান্ত বিশেষ বিধান বাতিল করে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে; এবং
২০. জাতিসংঘের সিডও সনদের অনুচ্ছেদ-২ ও ১৬(১)(গ)-এর ওপর হতে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে সনদটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
নারী দিবস নারী দিবসের সমাবেশ মহিলা পরিষদ সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি