জমি হেবা না করে উপহার দিলে হস্তান্তরের খরচ কম
৯ মার্চ ২০২২ ২৩:১০
জমিজমা বা সম্পত্তি নিকটাত্মীয়দের হেবা দলিলের মাধ্যমে হস্তান্তরের পদ্ধতিই আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। তবে হেবা দলিলের মাধ্যমে হস্তান্তর না করে উপহার হিসেবে সম্পত্তি হস্তান্তর করলে সেক্ষেত্রে খরচ কম হয়। কেননা, হেবা দলিলে সম্পত্তি হস্তান্তরে রেজিস্ট্রেশনের জন্য ৭ শতাংশ অর্থ সরকারকে ফি হিসেবে দিতে হয়। উপহারের ক্ষেত্রে এই খরচটি নেই। কেবল সম্পত্তি হস্তান্তরের জন্য চুক্তি করতে স্ট্যাম্পের যে খরচ, সেটি প্রযোজ্য হবে।
আইনি পরামর্শ বিষয় সারাবাংলার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বারস পাওয়ারড বাই প্রিমিয়ার ব্যাংক‘ অনুষ্ঠানে আইনজীবীরা এসব কথা বলেন। ‘জমিজমা বিষয়ক আইন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানটি সারাবাংলার ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। ভার্চুয়াল এই অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহ মনজুরুল হক। বিশেষ আলোচক ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. আব্দুল্লাহ আল শাইখ। ‘সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বারস’ সঞ্চালনা করেন ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন।
আলোচনায় জমিজমা হস্তান্তরের পদ্ধতিগুলোর তুলনা করে অ্যাডভোকেট শাহ মনজুরুল হক বলেন, হেবা দলিলের মাধ্যমে কেবল নিকটাত্মীয়দের মধ্যে জমিজমা হস্তান্তর করা যায়। সন্তানদের মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী বা ভাই-বোনের মতো সম্পর্কের ক্ষেত্রে হেবা করা যায়। সেক্ষেত্রে দলিল করার জন্য স্ট্যাম্পের খরচের সঙ্গে সঙ্গে জমির রেজিস্ট্রেশনের জন্য সরকারকে ৭ শতাংশ ডিউটি দিতে হয়। অন্যদিকে, এ সংক্রান্ত আইন সংশোধনের পর আত্মীয়দের মধ্যে উপহারের মাধ্যমেও সম্পত্তি হস্তান্তরের আইন করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনের খরচ লাগবে না। কেবল স্ট্যাম্পে দলিল করার জন্য প্রয়োজনীয় খরচটি লাগবে। এই পদ্ধতিতে কম খরচেই বড় বড় বা দামি সম্পত্তিও উপহার হিসেবে মালিকানা হস্তান্তর করা যাবে।
সম্পত্তি ওসিয়তের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, কোনো সম্পত্তির মালিক তার মোট সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত ওসিয়ত করতে পারবেন। এর চেয়ে পরিমাণ সম্পত্তি ওসিয়ত করার কোনো সুযোগ নেই।
অনুষ্ঠানে ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রির নিয়ম জানতে চেয়ে প্রশ্ন রাখেন একজন দর্শক। সেই প্রশ্নের উত্তরে শাহ মনজুরুল হক বলেন, সাধারণভাবে ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রি করার কোনো সুযোগ নেই। ওয়াকফ সম্পত্তির ওয়ারিশ যারা, তাদের শিক্ষা-চিকিৎসা কিংবা রুটি-রুজির সংস্থানের মতো অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনেই কেবল বিক্রি করার সুযোগ আছে। তবে সেক্ষেত্রে জেলা জজের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। এ সংক্রান্ত আবেদনকে বলা হয় পারমিশন মিসকেস। সেই আবেদন করে আদালতে প্রয়োজনের কথা তুলে ধরতে হবে। আদালত সন্তুষ্ট হয়ে অনুমতি দিলে তবেই বিক্রি করা যাবে ওয়াকফ সম্পত্তি।
এ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট মো. আব্দুল্লাহ আল শাইখ বলেন, ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রির অধিকার ওয়ারিশন বা আওলাদদের নেই। ২০১৩ সালে এই সম্পত্তি বিক্রির একটি আইন হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে নির্দেশনা দিয়ে এ সংক্রান্ত চারটি ধারা বাতিল করা হয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগ বলেছেন, ওয়াকফ যে উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়, বিক্রির সুযোগ থাকলে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। সেক্ষেত্রে ১৯৬২ সালের ওয়াকফ বিষয়ক যে অধ্যাদেশ, সেই অধ্যাদেশ অনুযায়ী একেবারেই জরুরি প্রয়োজনে প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রি করা যেতে পারে।
জমির মালিকানা দাবির জন্য কিংবা কারও কাছ থেকে জমি কিনতে হলে কোন কাগজপত্রগুলো থাকতে হবে, সে বিষয় নিয়েও আলোচনা করেন অ্যাডভোকেট মনজুরুল হক। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে জমির যেসব জরিপ হয়েছে, সেসব জরিপের রেকর্ডে নাম থাকলে সেটি ওই জমিতে তার মালিকানা স্বত্বের প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে সিএস রেকর্ড (ক্যাডেস্টাল সার্ভে), এসএ রেকর্ড (স্টেট অ্যাকুইজিশন রেকর্ড), আরএস রেকর্ড (রিভিশনেল সার্ভে) এবং বিএস রেকর্ড (বাংলাদেশ সার্ভে)। এসব রেকর্ডে নাম থাকাই জমির স্বত্বের প্রাথমিক প্রমাণ। এসব রেকর্ডে নাম থাকলে বোঝা যাবে ওই জমিতে আজ পর্যন্ত কারা কারা মালিকানায় ছিলেন।
জমি হস্তান্তরের বিভিন্ন পদ্ধতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সাধারণত উত্তরাধিকার সূত্রেই জমির হস্তান্তর হয় বেশি। জমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে মূলত তিন ধরনের পদ্ধতি আমাদের দেশে বেশি প্রচলিত। এর মধ্যে রয়েছে সেল ডিড বা জমি কেনা। এছাড়া ওসিয়ত, হেবা ও উপহারের মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর করা হয়। সেক্ষেত্রে কবলা বা বায়া দলিল করা হয়। এসব ক্ষেত্রে মালিক দাবি করার ব্যক্তির নাম রেকর্ডগুলোতে রয়েছে কি না, সেটি যাচাই করে নিতে হবে। রাজউকসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে জমি নিলে সেটি আবার সাধারণত লিজ দলিলের মাধ্যমে নিতে হয়। সেক্ষেত্রে লিজের জন্য চুক্তি করতে হয়। এরকম কোনো সম্পত্তি কারও কাছে কিনতে গেলে সেখানেও দলিলের রেকর্ডে মালিকানা পরম্পরা যাচাই করে নিতে হবে।
হাউজিং কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে জমি কেনার ক্ষেত্রেও মালিকানা মিলিয়ে নিতে হবে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী। তিনি বলেন, প্রাইভেট হাউজিং কোম্পানিগুলো কার কাছ থেকে জমি কিনেছে, সেই তথ্যগুলোও দলিল থেকে যাচাই করে নিতে হবে। তাদের সিএস রেকর্ডসহ অন্যান্য রেকর্ডের মালিকানার তথ্যও যাচাই করতে হবে।
সেল ডিডের মাধ্যমে কোনো জমি কিনলে রেজিস্ট্রেশন করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে কি না— এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার মো. আবদুল্লাহ আল শাইখ বলেন, জমি কিনতে গেলে রেজিস্ট্রেশনের আগে সাব-কবলা দলিল বা সেল ডিড করে নিতে হবে। এরও আগে বায়নানামা করার সুযোগ রয়েছে। অনেক সময় একবারে জমির দাম পরিশোধের সুযোগ না থাকলে সেক্ষেত্রে কিছু অর্থ পরিশোধ করে বায়নানামা করে রাখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বায়নানামায় কোনো সময়ের উল্লেখ না থাকলে বায়নানামা করার ছয় মাসের মধ্যে বাকি টাকা পরিশোধ করে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তবে দুই পক্ষ সম্মত থাকলে বায়নানামায় এক বছর বা নিজেদের সুবিধামতো যেকোনো সময় নির্ধারণ করে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে ওই সময়ের মধ্যে বাকি টাকা শোধ করে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
https://www.facebook.com/Sarabangla.net/videos/941865559838162
রাজউকের কাছ থেকে কোনো জমি নিলে সেটি হস্তান্তরের বিষয়ে আইনজীবীরা বলেন, রাজউকের কাছ থেকে লিজ নেওয়া সম্পত্তিও হেবা বা উপহারের মাধ্যমে হস্তান্তরা করা যায় এবং বিক্রিও করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে যে পদ্ধতিতেই হস্তান্তর করা হোক না কেন, তার জন্য রাজউকের অনুমতি প্রয়োজন হবে। তাছাড়া রাজউকের কাছ থেকে লিজ নেওয়ার সময় যেসব শর্ত প্রযোজ্য ছিল, জমি হস্তান্তরের পর নতুন মালিকদেরও সেসব শর্ত মেনে চলতে হবে।
সারাবাংলা/টিআর
অ্যাডভোকেট শাহ মনজুরুল হক জমি সংক্রান্ত আইন জমিজমা হস্তান্তর ব্যারিস্টার মো. আব্দুল্লাহ আল শাইখ (নিপ্পন) সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বার