প্রিয়জনকে হারিয়ে কাঁদছে সিলেটের মানুষ
৩০ এপ্রিল ২০২২ ১৮:০০
সিলেট: সারাদেশের মানুষের কাছে ছিলেন অর্থমন্ত্রী, সংসদ সদস্য। কিন্তু যে সিলেট-১ আসন থেকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই সিলেটের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবক-মুরব্বি। সিলেটের উন্নয়নে কাজ করে গেছেন নিরলস। সিলেটবাসীর যেকোনো আবদার-অনুরোধের শেষ আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। আর সে কারণেই তিনি সিলেটের মানুষের কাছে ছিলেন অকৃত্রিম স্বজন।
সেই আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ গোটা সিলেট। সিলেটবাসীর চোখে অশ্রু। তারা বলছেন, এরকম নির্লোভ, নিরহংকারী, সিলেটের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়া মানুষ বিরল। তেমন বিরল একজন মানুষের প্রয়াণ অপূরণীয় সিলেটের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
শুক্রবার (২৯ এপ্রিল) দিবাগত রাত পৌনে ১টার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। মধ্যরাত হলেও সিলেটে সে খবর ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। সঙ্গে সঙ্গেই শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে সিলেট। যারা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, সেহেরিতে উঠে তারাও প্রিয়জনকে হারানোর সংবাদটি পেয়ে গেছেন। এসময় রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই মুহিতের ধোপাদিঘীর পাড়ের বাসাতে ভিড় জমান। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
শনিবার (৩০ এপ্রিল) দুপুরে আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসায় যান সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা। সেখানে বসেই প্রিয় নেতাকে শেষ বিদায় জানানোর প্রস্তুতি নিতে থাকেন তারা।
সিলেটের এই সাবেক মন্ত্রীর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক। শেষ বয়সে রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও তিনি সিলেটের উন্নয়নের খবরাখবর রাখতেন। সিলেটের প্রতি তার বিশেষ টান ছিল। তিনি দলমত নির্বিশেষে সবার নেতা ছিলেন।
আরও পড়ুন-
- মুহিতের প্রথম জানাজা সম্পন্ন
- সিলেটের পথে মুহিতের মরদেহ
- সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিতের মৃত্যুতে শোক
- সাবেক অর্থমন্ত্রী আবদুল মুহিত আর নেই
- শহিদ মিনারে মুহিতকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা
- সদ্যপ্রয়াত মুহিতের দখলে বাজেট উত্থাপনের ২ রেকর্ড
- আব্দুল মুহিত ছিলেন একজন শতভাগ সৎ মানুষ: কাদের
- আমলা থেকে রাজনীতিবিদ-অর্থমন্ত্রী— বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার মুহিতের
- ‘প্রস্তুতি না থাকায় মুহিতের মরদেহ নেওয়া হচ্ছে না জাতীয় সংসদে’
- এপ্রিলে বাড়ি যেতে চেয়েছিলেন আবদুল মুহিত, এপ্রিলেই ‘ফিরছেন’ বাড়িতে
জেলা আওয়ী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, সাবেক এই মন্ত্রীর মৃত্যুতে সিলেটে ফের রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হলো। আমরা সবাই অভিভাবকহীন হলাম।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ বলেন, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত আমাদের অভিভাবক ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত সঙ্গী ও উন্নয়নের সারথী ছিলেন। তার মৃত্যুতে শুধু সিলেটে নয়, জাতীয়ভাবেও আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হলাম।
নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সিলেট-১ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আবুল মাল আবদুল মুহিত। দুই নির্বাচনেই জয় পাওয়া আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে দুই বারই মুহিত অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় রাজনীতি থেকে অবসর নেন তিনি। এর আগে থেকেই শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন তিনি। পরে বার্ধক্যসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় বিছানায় পড়ে যান তিনি। আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনা সংক্রমণেও। এরকম অসুস্থ শরীর নিয়েও মুহিত মার্চের মাঝামাঝিতে গিয়েছিলেন সিলেটে। ১৬ মার্চ তাকে সিলেট সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় ‘গুণীশ্রেষ্ঠ সম্মাননা’।
সিলেটবাসীর সঙ্গে আর দেখা হবে কি না— ওই অনুষ্ঠানে সেই সংশয় জানিয়েছিলেন আবদুল মুহিত। ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছিলেন সিলেটবাসীর কাছে। বলেছিলেন, ‘আমি একান্তভাবে সিলেটের মানুষ। এই যে আমাকে সম্মান জানাচ্ছেন, আমি সেই মাহাত্ম্যের কাছে মাথা নত করি। আমার ভুলত্রুটি সব মাফ করে দেবেন।’
দুই মেয়াদে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা মুহিতের বিচরণ ছিল সব ক্ষেত্রেই। খেলাধুলা ও সংস্কৃতি অঙ্গনেও যেকোনো আয়োজনে তিনি পাশে থাকতেন। সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহি উদ্দিন আহমদ সেলিম বলেন, সিলেটের ক্রীড়াঙ্গনে একশ বছরে যে উন্নয়ন হয়নি, তার (আবুল মাল আবদুল মুহিত) সময়ে তার চেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে। সিলেটে তিনি দু’টি স্টেডিয়াম নির্মাণ করে গেছেন। তার মৃত্যুতে সিলেটের ক্রীড়া পরিবার গভীরভাবে শোকাহত।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও আওয়ামী লীগ নেতা রজত কান্তি গুপ্ত বলেন, তিনি স্বচ্ছ চিন্তার মানুষ ছিলেন। সে কারণেই আমরা দেশসেরা একটি শহিদ মিনার পেয়েছি। নাটকের মহড়ার স্থানসহ সাংস্কৃতিক নানা বিষয়ে সিলেটে তার অবদান অপরিসীম। আমরা কখনো তার কাছে কিছু চেয়ে বিমুখ হইনি।
সিলেটের প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা কামরান আহমদের সন্তান ডা. আরমান আহমদ শিপলু বলেন, আমরা ধীরে ধীরে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছি।
এদিকে, শনিবার সকালে রাজধানীর গুলশান কেন্দ্রীয় মসজিদে (আজাদ মসজিদ) প্রথম জানাজার পর মুহিতের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। সেখানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তার মরদেহে শ্রদ্ধা জানান সামরিক সচিবরা। এছাড়া স্পিকার থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো শ্রদ্ধা জানায় তাকে। শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ।
এরপর আবুল মাল আবদুল মুহিতের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে বনানীর বাসা হয়ে তার মরদেহ নিয়ে সিলেটের পথে রওনা হয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। রাতে হিমাগারে রেখে রোববার (১ মে) বাদ জোহর আলিয়া মাদরাসা ময়দানে জানাজা শেষে তার মরদেহ রাখা হবে সিলেট শহিদ মিনারে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মা-বাবা ও দাদা-দাদির কবরের পাশে সমাহিত করা হবে আবুল মাল আবদুল মুহিতকে।
সারাবাংলা/টিআর
আবুল মাল আবদুল মুহিত শোকস্তব্ধ সিলেট সাবেক অর্থমন্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য সিলেট-১ আসন