Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খরস্রোত, নদীর গভীরতা— সব চ্যালেঞ্জই উৎরে গেছে পদ্মা সেতু

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৫ জুন ২০২২ ১১:১৪

ঢাকা: ভূমিকম্প, মাটির ক্ষয়সহ যেকোনো আঘাত প্রতিরোধ করে ঠিকে থাকবে পদ্মা সেতু। সব ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে ১০০ বছর ঠিকে থাকার শক্তি থাকছে স্বপ্নের এই সেতুর। এমন সক্ষমতা গড়ে তোলার উপযোগী করেই নির্মাণ করা হয়েছে পদ্মা সেতুর অবকাঠামো।

আজ শনিবার (২৫ জুন) স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন। মাওয়া প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন সেতুটির। এরপর আগামীকাল রোববার (২৬ জুন) সকাল থেকেই যানচলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের বহুল প্রতীক্ষিত সেতুটি। আর শত বছর টিকে থাকার মতো সব প্রকৌশল বিদ্যা প্রয়োগ করেই নির্মাণ করা হয়েছে সেতুটি।

বিজ্ঞাপন

দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে বাকি দেশের সঙ্গে সংযুক্ত করার এই যে মহাযজ্ঞ, সেই মহাযজ্ঞটি খুব সহজ কিছু ছিল না। দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম এই অবকাঠামো গড়তে ছিল বেশকিছু চ্যালেঞ্জ। প্রকৌশলগত সব চ্যালেঞ্জ জয় করেই শেষ পর্যন্ত গড়ে তোলা হয় এই সেতু। আর স্বপ্নের এই সেতুটি যেন যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে থাকে, সেটিও নিশ্চিত করা হয় এর নকশায়।

পদ্মা সেতু যেন ভূমিকম্প ও মাটির ক্ষয়সহ যেকোনো ধরনের ঘাত প্রতিরোধী হয়, সেজন্য বাঁকা করে নদীর তলদেশে নিয়ে গাঁথা হয়েছে খুঁটি। আর গাড়ি ও মালবাহী দ্বিতল রেলের ভার বহনে সক্ষম করার জন্য এই খুঁটিগুলো পুঁতে দেওয়া হয়েছে নদীর ৪২০ ফুট গভীরে। এই গভীরতা একটি ৪২ তলা ভবনের সমান!

পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের তথ্য, পদ্মার উপরিতল থেকে নদীর তল পর্যন্ত গভীরতা প্রায় ১৩০ ফুট। আর পানির তোড়ে নদীর তল থেকে মুহূর্তেই যে পরিমাণ মাটি সরে যায়, তা ২০০ ফুটেরও বেশি গভীর খাদ তৈরি করে। অর্থাৎ সেতুর খুঁটি স্থাপন করতে হলে তা কমপক্ষে ৩৩০ ফুট বা ৩৩ তলা ভবনের সমান উচ্চতার খুঁটি হতে হবে। সেতুর চূড়ান্ত নকশায় খুঁটিগুলো স্থাপন করা হয়েছে এর চেয়েও ৯০ ফুট বেশি, মোট ৪২০ ফুট গভীরতায়।

বিজ্ঞাপন

পদ্মা সেতুর প্রকৌশলগত জটিলতা নিরসনে বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করা হয়েছিল। আমৃত্যু সেই প্যানেলের প্রধান ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রকৌশলী ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। পদ্মার প্রকৌশলগত জটিলতাগুলো নিয়ে একাধিকবার তার সঙ্গে কথা হয়েছিল সারাবাংলার।

ড. জামিলুরের দেওয়া তথ্য বলছে— পানি প্রবাহের দিক থেকে দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজানের পরই বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী বলা যায় পদ্মাকে। সেকেন্ডে ১৪০ হাজার ঘন মিটার পানি প্রবাহিত হয় এই নদীকে।

সেতুর নকশা প্রণয়ণের সময় এই বিষয়টিকে মাথায় রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন ড. জামিলুর। তিনি বলেছিলেন, একশ বছরে পদ্মায় কী পরিমাণ পানি প্রবাহিত হতে পারে, সেই হিসাবটি বিবেচনা করা হয়েছে। দেখা গেছে, মাত্র ২০ সেকেন্ড যে পরিমাণ পানি পদ্মা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়, তা দিয়ে পুরো ঢাকা শহরের সব মানুষের একদিনের পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

ব-দ্বীপ বাংলাদেশের গঠনগত বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ এলাকা পলি মাটির। হিমালয় থেকে শুরু করে মাটি ক্ষয় হতে হতে পানির সঙ্গে মিশে সেটা বসে গিয়ে গঠিত হয়েছে এই ব-দ্বীপ। ভূতত্ত্ববিদদের ধারণা, ব-দ্বীপ হিসেবে বাংলাদেশ এখনো নতুন, যাকে বলা হয়ে থাকে ‘ইয়াং ডেল্টা’।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত সেতু নির্মিত হয়েছে বা এখনো নির্মাণ কাজ চলছে, তার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজটি কারিগরি দিক থেকে অন্যতম জটিল একটি কাজ। এর পেছনে তারা মূলত দুইটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, নদীর নির্মানাধীণ স্থানে পরিবর্তনশীল গতিপথ নিয়ন্ত্রণ; দ্বিতীয়ত, নদীর তলদেশের স্তর ভবিষ্যতে আরও নিয়ে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা।

জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছিলেন, পদ্মা সেতু বিশ্বের অনন্য বৈশিষ্ট্যের একটি সেতু। এর কারণ তলদেশের গভীরতা। পদ্মা নদীর ১০ কিলোমিটার নিচে গিয়ে পাথরের স্তর। বিশ্বের অন্য কোনো নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে পাথরের স্তর পেতে এত নিচে যেতে হয় না।

শেষ পর্যন্ত ৪২০ ফুট গভীরতায় খুঁটি স্থাপন করতে গিয়ে বড় একটি চ্যালেঞ্জ ছিল হ্যামার। কারণ এরকম খরস্রোতা নদীর এত গভীরে পাইলিংয়ের জন্য যে বিশালাকৃতির হ্যামার প্রয়োজন, বাস্তবে এরকম কোনো হ্যামারের অস্তিত্বই ছিল না। শেষ পর্যন্ত জার্মান প্রযুক্তি ব্যবহার করে নেদারল্যান্ডসের একটি কোম্পানি থেকে বিশেষ অর্ডার দিয়ে আনা হয়েছিল এই হ্যামার। এত শক্তিশালী হ্যামার পৃথিবীর আর কোথাও কখনো ব্যবহৃত হয়নি।

প্রকৌশলীদের ভাষ্য, পদ্মা সেতুর কাঠামোকে অসম্ভব শক্তিশালী করে তোলা হয়েছে। কারণ পদ্মা নদীর যে পরিবর্তনশীল চরিত্র, তা যেন এই সেতুকে কোনোভাবেই টলাতে না পারে। তাছাড়া পদ্মা সেতুর ধারণক্ষমতাও অনেক বেশি করা হচ্ছে। কারণ এর ওপর কেবল চার লেনের সড়ক পথ নয়, থাকছে রেলপথও।

সব মিলিয়েই পদ্মার গভীরতা আর খরস্রোত বারবার পদ্মা সেতুর অবকাঠামো নকশায় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে হাজির হয়েছে। তবে একাগ্রচিত্তে সেসব সমস্যার সমাধানও বের করে নিয়ে এসেছেন প্রকৌশলীরা। তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু ৪১টি স্প্যান মিলিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য নিয়ে এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত দেশের দুই প্রান্তকে মিলিয়ে দিতে। পদ্মা পাড়ে তাই এখন চলছে উৎসবের আবহ।

সারাবাংলা/টিআর

খরস্রোত পদ্মা সেতু পদ্মা সেতুর উদ্বোধন পদ্মা সেতুর প্রকৌশলগত দিক প্রমত্তা পদ্মা স্বপ্নের পদ্মা সেতু

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর