৪ দিন বয়সী নবজাতককে নিয়ে বাড়ি ফেরা হলো না রাসেলের
১০ জুলাই ২০২২ ১০:০০
কুমিল্লা থেকে: বাবা হিসেবে নিজের জীবনের প্রথম ইদ কাটাবে সন্তানের সঙ্গে। বাচ্চা জন্ম নেওয়ার পরে আজকে ছিল চতুর্থ দিন। তাকে নিয়ে আজই বাড়ি ফিরবে, এরপরে ওর নামকরণ করবে— এমন আরও অনেক কিছুর পরিকল্পনা করছিল ওর বাবা। নিজ থেকেই ঘরে বাচ্চার অনেক কিছু কিনেছিল ওর বাবা। আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল বাচ্চার জন্য আর কিছু কিনতে হবে কিনা? আমি বলেছিলাম, কিছুই লাগবে না। শুধু আমাদের এসে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে গেলেই হবে। এরপরে যখন রওয়ানা দেয় তখন আমাদের হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিতে বলল।
কিন্তু ঘণ্টার পরে ঘণ্টা পার হলেও বাচ্চার বাবা আর ফিরে আসেনি। সবাই কেমন যেন করছিল। এমন সময়ে জানতে পারি আমার বাচ্চাকে এতিম করে দিয়ে ওর বাবা আর নেই। এখন ওর নাম কে রাখবে? ওকে কে দেখবে আর আমাকে কে দেখবে? আমার তো সব শেষ হয়ে গেল। আল্লাহ্ আমার বাচ্চার কেন এই দিন দেখালেন?
স্বামী রাসেল প্রধানের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনায় কান্না যেন থামছেই না স্ত্রী মাহমুদা আক্তারের। একই গ্রামের প্রতিবেশী তিনজন তরুণের বাসচাপায় নিহত হওয়ার ঘটনায় পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ। শোকে মুরছা যাচ্ছিল পরিবারের সদস্যরা। ইদের আনন্দকে ছাপিয়ে পুরো এলাকা জুড়েই কান্নার শব্দ।
শনিবার (৯ জুলাই) সকাল ১০টায় নবজাতক সন্তান ও স্ত্রীকে নিতে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে যাওয়ার জন্য মোটরবাইকে রওয়ানা দেন ২৫ বছর বয়সী রাসেল প্রধান। উপজেলার বেকিনগর গ্ৰামের প্রধান বাড়ির মো. আবদুল হকের ছেলে রাসেল প্রধান ছিলেন আলোকিত সকাল ও স্থানীয় দৈনিক সমাজকণ্ঠের দাউদকান্দি উপজেলার প্রতিনিধি। বাড়ি থেকে বের হয়ে মোটরবাইকে সঙ্গে নেন একই এলাকার প্রতিবেশী শাহজালাল মিয়ার ছেলে মো. শরীফ ও মো. তাফসিরকে।
বাড়ি থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্বেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। আর তার একটু পরেই ইলিয়টগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল। কিন্তু সেখানে আর পৌঁছানো সম্ভব হয়নি রাসেল, শরীফ ও তাফসিরের।
বেকিনগর জিংলাতলী সড়ক থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওঠার সময়েই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে রাসেলদের বাইক। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মোটর বাইক মূল সড়কে উঠতেই পেছন থেকে দ্রুতগামী একটি বাস পেছন থেকে তাদের ধাক্কা দেয়। বাসটিও এ সময় সড়কের পাশে উলটে যায়। এর আগে যাত্রীবাহী বাসকে ধাক্কা দেয় ঢাকাগামী একটি ট্রাক। আল বারাকা পরিবহন নামের বাসে থাকা কারো তেমন ক্ষতি না হলেও ঘটনাস্থলেই মারা যায় রাসেল, শরীফ ও তাফসির। পরে স্থানীয়রা তাঁদের দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গৌরীপুরে জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
জানাজা শেষে বিকেলে রাসেল, শরীফ ও তাফসিরের মৃতদেহ দাফন করা হয় পাশাপাশি। গ্রামের প্রায় সবারই মুখে এই দুর্ঘটনার আলোচনা। কান্না করতে করতে মূর্ছা যাচ্ছিলেন রাসেল প্রধান ও তার সঙ্গে থাকা দুই সহোদর শরীফ এবং তাফসিরের পরিবারের সদস্যরা।
রাসেল প্রধানের মামা মনির হোসেন বলেন, ‘৬ জুলাই আমার ভাগিনা প্রথম সন্তানের বাবা হয়। ইলিয়টগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার ঘরে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। আর এরপর থেকেই সে খুব খুশি ছিল। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন আজই সন্তান ও তার মাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। সে জন্য রাসেল মোটর সাইকেল নিয়ে রওয়ানাও দিয়েছিল। কিন্তু আমার আদরের ভাগিনা আর বাড়ি ফিরে এলো না। কি বলবো এখন আমরা তার সন্তানকে?’
তিনি বলেন, ‘রাসেল স্থানীয় একটি পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করত। বছর-খানেক আগে চান্দিনা উপজেলার রানীপুরের মাহমুদা আক্তার ও তার বিয়ে হয়। আমরা কেউই রাসেলের মৃত্যুর খবর তার স্ত্রীকে দিতে চাইনি। তারপরও সে কীভাবে যেন শুনে ফেলেছে। এরপর থেকেই সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল বারবার।’
রাসেল প্রধানের ছোট ভাই আরিফ বলেন, আজ (শনিবার, ৯ জুলাই) হাসপাতাল থেকে বাচ্চাকে এনে কোরবানির পশু কিনতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর আগে আমার ভাইকেই হারালাম। একইসঙ্গে আমাদের প্রতিবেশী দুই ভাইকেও হারালাম। তিনজনের লাশ যখন আনা হয় তখন আসলে আমরা আর কোনোভাবে মানতে পারছিলাম না। আমার বাবা-মাসহ কেউ এখন পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছি না যে ভাই আর নেই।
রাসেলের স্ত্রী মাহমুদা বলেন, আমাকে গতকালও ফোনে বলছিল বাড়িতে সবকিছু কিনে আনছি। আর কিছু কী লাগবে? আমি বলছি, আর কিচ্ছু লাগবে না।
তিনি বলেন, ‘আজকে সকালে রওয়ানা দেওয়ার আগে আমার স্বামী বলছিল- তোমরা রেডি হও আমি আসছি। বাড়িতে নিয়ে সন্তানের নাম দিবে। একসঙ্গে ইদের আনন্দ কাটাবে সন্তানকে কোলে নিয়ে। কিন্তু এরপরে আর ফোন করে নাই। তার ঘণ্টাখানেক পরে শুনি আমার স্বামী আর নেই। বাস চাপা দেওয়ার কারণে মারা গেছে। আমার মেয়েটা নামকরণের আগেই এতিম হয়ে গেল।’
রাসেল প্রধানের বাবা মো. আবদুল হক কোনোভাবেই যেনো বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সন্তান হারানোর সংবাদ।
কান্না করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনিও।
তিনি বলেন, ‘এই বয়সে ছেলেকে হারানো কেমনে মানা যায়? তার বাচ্চাটাতো এখনো তারে বাবাও ডাকতে পারে নাই। আল্লাহ এ কি দিন দেখালেন আমাদের। তিনটা তাজা প্রাণ একটা মুহূর্তে নাই হয়ে গেল।’
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার উপ-পরিদর্শক মো. সালাউদ্দিন জানান, সাড়ে ১০টায় লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকামুখী আল বারাকার একটি বাস জিংলাতলী এলাকায় আসলে সামনে একটি মোটরসাইকেল এসে পড়ে। এ সময় পাশ কেটে যাওয়ার চেষ্টা করেন বাসচালক। পরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিয়ে সড়কের একপাশে উল্টে যায়। এ সময় একটি ট্রাক বাসটিকেও ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী তিন জন নিহত হয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়া শেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে নিহত ব্যক্তিদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। যাত্রীবাহী বাসটি ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে রাখা হয়েছে।’
দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার ওসি ফরিদুল ইসলাম জানান, জিংলাতলী-বেকিনগর সড়ক থেকে একটি মোটরসাইকেল মহাসড়কে উঠলে ঢাকামুখী আল বারাকা পরিবহনের একটি বাস ওই মোটরসাইকেলকে চাপা দেয়। এ সময় বাসটি সড়কের পাশে উল্টে যায়। এ বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে।
সারাবাংলা/এসবি/একে