‘কালোবাজারি’র টিকিট না পেয়ে শ্রমিক লীগ নেতাদের তুলকালাম
২০ জুলাই ২০২২ ২২:৪৭
রাজশাহী: ‘কালোবাজারি’র টিকিট না পেয়ে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টারের রুমে গিয়ে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘অশ্লীল’ ভাষায় গালিগালাজ করেছেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের কর্মচারীরা। রেলওয়ের সাবেক এক কর্মকর্তাও চরম উত্তেজিত হয়ে স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে উচ্চবাচ্য করেছেন। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজারসহ কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে হুমকিও দিয়েছেন। রেলওয়ের এই কর্মচারীরা বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগের নেতাও।
গত রোববার (১৭ জুলাই) রাত সাড়ে ১০টার দিকে টিকিট না পেয়ে স্টেশন মাস্টারের রুমে গিয়ে অশ্লীল গালিগালাজের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
স্টেশন মাস্টারকে গালি দেওয়া রেলওয়ের ওই কর্মচারীর নাম দেবব্রত সিনহা। তিনি পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী দফতরের উচ্চমান সহকারী হিসেবে কর্মরত। রেলওয়ে শ্রমিক লীগের যুগ্ম সম্পাদক তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ওয়েলফেয়ার ইন্সপেক্টর ও বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি ওয়ালী খান।
এ ঘটনায় রেলওয়ে জিআরপি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী আবদুল মোমিন এই জিডি করেন দেবব্রত সিনহা ও ওয়ালী খানের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ উঠেছে, ‘নেশাগ্রস্ত’ অবস্থায় গত রোববার রাতে স্টেশন মাস্টারের রুমে যান রেলের কর্মচারী দেবব্রত সিনহা। তার সঙ্গে মহানগর শ্রমিক লীগ নেতা ও সাবেক রেল কর্মকর্তা ওয়ালী খানও ছিলেন। তারা কর্তব্যরত স্টেশন মাস্টারের রুমে ঢুকেই হইচই শুরু করেন। চাহিদামতো টিকিট না পাওয়ায় তখন চরম উত্তেজিত হয়ে দেবব্রত সিনহা রেলের দুই কর্মকর্তাকে ‘অশ্লীল’ ভাষায় গালাগাল করেন। এসময় ওয়ালী খান টিকেট না পেয়ে জিএমকে হুমকি-ধমকি দেন এবং স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী আবদুল মোমিনকে তৎক্ষণাৎ স্টেশন মাস্টারের রুমে ডেকে নিয়ে আসতে নির্দেশ দেন।
জানতে চাইলে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী আবদুল মোমিন বলেন, দেবব্রত সিনহা রেলের একজন কর্মচারী। কিন্তু তার অত্যাচারে আমরা বুকিং সহকারীরা অতীষ্ঠ। সাধারণত বুকিং সহকারীদের ডিউটি না থাকলে টিকিট কাউন্টারের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। অথচ রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী দফতরের উচ্চমান সহকারী দেবব্রত প্রতিনিয়ত টিকিটের জন্য কাউন্টারের ভেতরে জোর করে ঢুকে টিকিটের জন্য ধরনা দিয়ে আসছে।
তিনি আরও বলেন, টিকিট না দেওয়া পর্যন্ত কাউন্টারের কম্পিউটার ও সার্ভারের পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। প্রতিদিনের মতো সে ১৬ জুলাই এসে ১৭ তারিখের যাত্রার টিকিটের জন্য চাপ দেয়। কিন্তু ১৭ তারিখে জিএম স্যারসহ পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অফিশিয়াল কাজে ঢাকায় যান। এ কারণে তাকে আমি টিকিট দিতে পারিনি। এজন্য ১৭ জুলাই রাতে দেবব্রত কয়েকজনকে নিয়ে আমাকে খুঁজতে আসে, জোর করে কাউন্টারে ঢুকে কাউন্টার অফিস ঘেরাও করে।
ওই দিন দুই দিনের টিকিট বিক্রির প্রায় ৬০-৭০ লাখ টাকা কাউন্টার অফিসে ছিল জানিয়ে আবদুল মোমিন বলেন, ১৭ জুলাই রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে আমাকে কাউন্টারের ভেতরে না পেয়ে কতর্ব্যরত স্টেশন মাস্টারের রুমে গিয়ে আমাকে ও রেলের আরও কয়েকজন কমকর্তার উদ্দেশে তারা অকথ্য-অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে। তাই জীবনের নিরাপত্তা ও এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রেলওয়ে জিআরপি থানায় জিডি করেছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও স্টেশনের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ১৫ জুলাই টিকিটের জন্য দেবব্রত সিনহা তিন বার (সকালে একবার ও বিকেলে দুই বার) কাউন্টার অফিসের ভেতরে প্রবেশ করেন। প্রধান বুকিং সহকারী আবদুল মোমিন জানান, ওই দিন তিনি ১৬ তারিখের যাত্রার ধূমকেত এক্সপ্রেস ট্রেনের সাতটি এসি চেয়ার, পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনের চারটি এসি চেয়ার, সিল্কসিটির একটি এসি চেয়ার এবং এই তিন ট্রেন মিলিয়ে ১২টি শোভন চেয়ারের টিকিটসহ মোট ২৪টি টিকিট আমাদের কাছ থেকে জোর করে নিয়ে যায়।
আবদুল মোমিন আরও জানান, এর আগের দিন ১৪ জুলাইও তারা বিভিন্ন ট্রেনের ২০-২৫টি টিকিট নিয়ে যান। আরও আগে থেকেই তারা এই কাজটি নিয়মিত করে আসছেন। তবে ১৬ জুলাই গিয়ে ১৭ জুলাইয়ের টিকিট না পেয়েই স্টেশন মাস্টারের রুমে গিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটান তারা।
জানতে চাইলে রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ওয়েলফেয়ার ইন্সপেক্টর ওয়ালী খান বলেন, যা সত্য তাই বলছি। সবাই টিকিট পায়, আমরা টিকিট পাই না। কেন আমরা টিকিট পাই না, তা জানার জন্যই মূলত স্টেশন মাস্টারের রুমে গিয়েছিলাম।
আরেক অভিযুক্ত দেবব্রত সিনহা বলেন, আমি ১৪ তারিখে তিনটি টিকেট নিয়েছি মাত্র। আর কখনো টিকেট নিইনি। জমসেদ নামের একজন রেলওয়েতে চাকরি করে না। অথচ তাকে টিকেট দেওয়া হলেও আমাকে দেওয়া হয়নি। এজন্য আমি জমসেদকে গালাগালি করেছি।
১৫ জুলাই তিন বার স্টেশন কাউন্টারের ভেতরে ঢোকার বিষয়ে জানতে চাইলে দেবব্রত বলেন, ‘টিকিট নিতেই গিয়েছিলাম। কিন্তু টিকেট দেওয়া হয়নি আমাকে। মূলত রাজনৈতিকভাবে আমাকে হেয় করার জন্য রেলওয়ে শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান উঠেপড়ে লেগেছে।’ তবে ১৬ জুলাই স্টেশন মাস্টারের রুমে যা কিছু বলেছেন, তা বলা উচিত হয়নি বলেও স্বীকার করেন দেবব্রত সিনহা।
জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল রেলের জিএম অসীম কুমার তালুকদার বলেন, কালোবাজারির টিকিট দেওয়া বন্ধ করার কারণেই স্টেশন মাস্টারের রুমে গিয়ে ওই কর্মচারী (দেবব্রত সিনহা) উত্তেজিত হয়ে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিয়েছে। আমি ঢাকায় আছি, লিখিত অভিযোগ পেলে ঘটনার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে, গত সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে কালোবাজারির টিকিট বিক্রির সময় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে জিয়াউর রহমান (৩৬) নামে রেলওয়ের এক কর্মচারীকে আটক করে রলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি)। তার কাছ থেকে ধূমকেতু এক্সপ্রেসের পাঁচটি কালোবাজারির টিকিটও জব্দ করা হয়। পরে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে।
আটক জিয়াউর রাজশাহী মহানগরীর রেল কলোনি এলাকার আবদুর রাজ্জাকের ছেলে এবং পশ্চিম রেলের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয়ে বার্তাবাহক হিসেবে কর্মরত। টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত অভিযোগে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানান পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জিএম অসীম কুমার তালুকদার। তদন্তসাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
সারাবাংলা/টিআর