Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান ছিল না— তদন্তে পেয়েছে রেল পুলিশ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১ আগস্ট ২০২২ ২০:৪৮

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার বড়তাকিয়া রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার সময় রেলের গেটম্যান সাদ্দাম হোসেন সেখানে ছিলেন না বলে তদন্তে তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। সাদ্দাম মসজিদে নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলেন বলে তথ্য পেলেও তা এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি রেল পুলিশ।

রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় ১১ জনের নিহতের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় গেটম্যান সাদ্দাম হোসেন গ্রেফতারের পর এখন কারাগারে আছেন। তবে গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাদ্দাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার দাবি করেছেন বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সীতাকুণ্ড রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) খোরশেদ আলম।

বিজ্ঞাপন

তদন্ত তদারক কর্মকর্তা রেলওয়ে পুলিশের চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার হাসান চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ট্রেনের চালক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং আমাদের নিজস্ব তদন্তে জানতে পেরেছি যে, দুর্ঘটনার সময় গেটম্যান ঘটনাস্থলে ছিলেন না। এ সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পরই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরেকটি তথ্য হচ্ছে যে তিনি মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। সেটি যাচাই-বাছাই না করে বলা যাচ্ছে না। ব্যারিয়ার ফেলা হয়নি এমন তথ্যও পেয়েছি। আমরা মাত্র তদন্ত শুরু করেছি। পূর্ণাঙ্গ তদন্তে সবকিছু বেরিয়ে আসবে।’

তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এসআই খোরশেদ আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেটুকু তদন্ত হয়েছে তাতে আমরা সাদ্দামের অপরাধই পাচ্ছি। গ্রেফতারের পর তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। অপরাধী কখনও অপরাধ স্বীকার করে না। সাদ্দামও করেনি। তাকে প্রয়োজনে আমরা রিমান্ডে নিতে পারি। জামিন হয়ে গেলে আদালতে সেটি বাতিলের আবেদনও করা যাবে, সেটি সমস্যা নয়। কিন্তু আমরা আগে তদন্তের প্রাথমিক কাজগুলো, সাক্ষ্যপ্রমাণ গুছিয়ে নিচ্ছি। এরপর সাদ্দামকে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

বিজ্ঞাপন

দুর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী বড়তাকিয়া এলাকার বাসিন্দা মো. হাসান সারাবাংলাকে বলেছিলেন, ‘রেলগেটের লাইনম্যান ‍দুর্ঘটনার সময় ছিলেন না। গেটে ব্যারিয়ার ফেলা হয়নি। ফলে মাইক্রোবাসটি রেললাইনে উঠে যায়। তখন ট্রেন ধাক্কা দেয়। যদি বাঁশ ফেলা হতো তাহলে মাইক্রোবাসটি রেললাইনে উঠতে পারত না।’

মফিজুল হক নামে স্থানীয় আরেক বাসিন্দা জানিয়েছিলেন, দুর্ঘটনার সময় গেটম্যান মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তিনি মসজিদ থেকে ছুটে আসেন।

দুর্ঘটনার সময় মহানগর প্রভাতী এক্সপ্রেস ট্রেনের চালকের দায়িত্বে ছিলেন জহিরুল হক খান। দুর্ঘটনার পর তিনি একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, গেটম্যান যদি ঘটনাস্থলে থাকতেন তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত না। তবে গেটম্যান ছিলেন কি না তিনি দুর্ঘটনার সময় খেয়াল করতে পারেননি।

দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে জহিরুল হক খানের বক্তব্য, ‘এখানে অনেক চলাচলের পথ আছে যেগুলো বৈধ নয়। কারণ স্বাভাবিকভাবে ব্যারিয়ার থাকলে এমন দুর্ঘটনা ঘটত না। আর ওখানে কোনো গেটম্যান ছিল কি না আমি খেয়াল করতে পারিনি। তবে গেটম্যান থাকলে এই ঘটনা ঘটত না। এ ছাড়া গেটে কোনো সিগন্যালও ছিল না। একটা ট্রেন যদি ব্র্যাক করার জন্য সুইস দেওয়া হয়, তাহলে সেটি গিয়ে দাঁড়াবে ৪৪০ গজ পর। কিন্তু দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িটি এতটা কাছে ছিল, যার ফলে ব্র্যাক করেও রক্ষা হয়নি। তবে এই দুর্ঘটনার পেছনে অন্যতম ভুল ছিল মাইক্রোবাসটির চালকেরও।’

গত শুক্রবার (২৯ জুলাই) দুপুরে মীরসরাই উপজেলার বড়তাকিয়া রেলক্রসিংয়ে রেললাইনে উঠে পড়া একটি মাইক্রোবাসকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী এক্সপ্রেস ট্রেন ধাক্কা দেয়। এতে ১১ জন ঘটনাস্থলেই মারা যান। আহত ছয়জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। মাইক্রোবাসের এক আরোহী অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হন।

গেটম্যান সাদ্দাম হোসেন

দুর্ঘটনায় নিহত ১১ জনের সবাই মাইক্রোবাসের আরোহী ছিলেন। তাদের সবাই হাটহাজারী উপজেলার চিকনদণ্ডি ইউনিয়নের খন্দকিয়া ও আশেপাশের গ্রামের বাসিন্দা। এদের মধ্যে ৯ জন বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র। খন্দকিয়া যুগীরহাট এলাকার আরএনজে কোচিং সেন্টারের বিদায়ী শিক্ষার্থীদের নিয়ে চার শিক্ষক পিকনিকের উদ্দেশে মীরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝর্ণা এলাকায় গিয়েছিলেন।

নিহত ১১ জন হলেন- সামিরুল ইসলাম হাসান (১৬), মুসাব আহমেদ হিশাম (১৬), ইকবাল হোসেন মারুফ (১৬), জিয়াউল হক সজীব (২১), ওয়াহিদুল আলম জিসান (২৪), রিদওয়ানুল চৌধুরী (২২), মোস্তফা মাসুদ রাকিব (২০), আসিফুল ইসলাম আশিক (১৯), শান্ত শীল (১৯), সাজ্জাদ হোসেন (২০) এবং গোলাম মোস্তফা নীরু (২২)।

একই দুর্ঘটনায় আহত ছয়জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এরা হলেন- তছমির হাসান পাবেল (১৬), মহিবুল ইসলাম মাহিম (১৮), মো. সৈকত হোসেন (১৬), তানভীর আলম হৃদয় (১৮), আয়াতুল ইসলাম (১৬) এবং মাইক্রোবাসের চালকের সহকারী তৌকিদ ইবনে শাওন (২০)।

নিহতদের মধ্যে সাতজনের বাড়ি চিকনদণ্ডী ইউনিয়নের খন্দকিয়া গ্রামে। বাকিদের মধ্যে নিহত রাকিবের বাড়ি একই উপজেলার শিকারপুর, সাজ্জাদের মাদার্শা, শান্ত শীলের সরকারহাট এবং আশিকের বাড়ি ফতেপুর গ্রামে।আহত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের বাড়ি খন্দকিয়া গ্রামে। শুধুমাত্র মাইক্রোবাসের চালকের সহকারী শাওনের বাসা চট্টগ্রাম নগরীর শেরশাহ এলাকায়।

নিহতদের মধ্যে তিনজন স্কুলছাত্র ও ছয়জন কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। সামিরুল, হিশাম ও মারুফ খন্দকিয়া গ্রামের কে এস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। সজীব ওমরগণি এমইএস কলেজের গণিত প্রথম বর্ষের ছাত্র। জিসান ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেছেন। রিদওয়ানুল চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। রাকিব হাটহাজারী কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করে অনার্সে ভর্তির জন্য অপেক্ষমাণ আছেন। আশিক ও শান্ত শীল কে সি শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

নিহত সজীব, রিদওয়ানুল, রাকিব ও জিসান যুগীরহাটের আরএনজে কোচিং সেন্টারের পরিচালক ছিলেন। সামিরুল, হিশাম, মারুফ, আশিক ও শান্ত ওই কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন। নিহত সাজ্জাদ পড়ালেখার সঙ্গে যুক্ত নন। সজীবের বন্ধু হিসেবে তিনিও পিকনিকে গিয়েছিলেন। নিহত গোলাম মোস্তফা নীরুও সজীবের বন্ধু এবং মাইক্রোবাসটির চালক ছিলেন।

আহতদের মধ্যে তছমির, আয়াতুল ও সৈকত কে এস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। মাহিম ও হৃদয় কে সি শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

একইসঙ্গে যাওয়া কে সি শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. ইমন (১৯) অক্ষত আছেন। তাকে চমেক হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।

এ ঘটনায় চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার অধীন সীতাকুণ্ড পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) জহিরুল ইসলাম বাদী হয়ে সাদ্দামকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন। মামলায় অবহেলা জনিত মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩৩৮ (ক), ৩০৪(ক) ও ৪২৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।

দুর্ঘটনার পরপরই রেলওয়ে পুলিশ সাদ্দামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিয়েছিল। মামলা দায়েরের পর তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। পরদিন বিকেলে সাদ্দামকে আদালতে হাজিরের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

আরও পড়ুন
এক ঝড়েই স্তব্ধ খন্দকিয়া
৭ মাসে রেলপথে ঝরল ১৭৮ প্রাণ
মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় নিহত বেড়ে ১১
মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কা: রেলের ২ তদন্ত কমিটি
মীরসরাই ট্র্যাজেডি: রেলকে দুষলেন মহিউদ্দিন রনি
রেলের গেটম্যান সাদ্দামকে আসামি করে মামলা
মীরসরাই ট্র্যাজেডি: রেলের গেটম্যান সাদ্দাম কারাগারে
মহানগর প্রভাতী ট্রেনে কাটা পড়ে ফের একজনের মৃত্যু
রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান ছিল না— বলছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা
ট্রেনের ধাক্কায় ১১ জনের মৃত্যু: গেটম্যান পুলিশ হেফাজতে

 

সারাবাংলা/আরডি/একে

মীরসরাই রেলক্রসিং

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর