শিক্ষা উপকরণ নিয়ে স্কুলের দোকানদারি
১৮ নভেম্বর ২০২২ ১৮:০৫
ঢাকা: বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন স্কুল কলেজে চলছে শিক্ষা উপকরণ বাণিজ্য। শিক্ষার্থীদের ইউনিফর্ম, প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রামযুক্ত খাতা, ডায়েরি ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ প্রতিষ্ঠানের মনোনীত টেইলার্স ও লাইব্রেরি থেকেই কিনতে হয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নির্দিষ্ট একটি রুমেই চলেছে টেইলার্সের কাজ। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বাইরের একটি নির্দিষ্ট টেইলার্স নির্ধারণ করে দিচ্ছে। একই অব্স্থা বই ও স্টেশনারির ক্ষেত্রেও। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ভবনেই লাইব্রেরি রয়েছে কিংবা বাইরের কোনো নির্দিষ্ট লাইব্রেরি থেকেই কিনতে হচ্ছে খাতা-কলম ও প্রয়োজনীয় বইপত্র। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ এই উপকরণ বাণিজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন অভিভাবকরা। অনৈতিক এই চর্চা দ্রুত বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ চান শিক্ষাবিদরা।
অভিভাবকরা বলছেন, দেশের প্রায় সব স্কুল কলেজেই শিক্ষা উপকরণ নিয়ে ‘দোকানদারি’ চলছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ থেকেই ইউনিফর্ম ও খাতা-পত্র কিনতে হয় বলে সারাবাংলাকে জানান রুবেল নামের একজন অভিভাবক। ধানমন্ডি শাখায় নবম শ্রেণিতে পড়েন তার মেয়ে।
সারাবাংলাকে রুবেল বলেন, ‘স্কুলের ভেতরে একটি রুম আছে। সেখান থেকেই স্কুল ড্রেস কিনতে হয়। ওখান থেকে না কিনলে কালার মেলে না। ক্যাম্পাসের ভেতরে যে রুম আছে, সেখানে টেইলারের লোক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কাজ করেন।’
তিনি বলেন, ‘ধানমন্ডি শাখার ক্ষেত্রে নাহিদ বুক স্টল নামে একটি লাইব্রেরি রয়েছে। সেখানে থেকেই স্কুলের খাতা কিনতে হয়। খাতার উপরে স্কুলের নাম লেখা থাকে। বছরের প্রথম দিকে সেট নির্ধারণ করে দেয়। বাংলার জন্য যদি নীল খাতার কথা বলা হয় তবে নীল খাতাই কিনতে হয়। অন্যটি হলে চলে না। ফলে বাধ্য হয়ে ওই লাইব্রেরি থেকেই খাতা কিনতে হয়। লাইব্রেরিটি একচেটিয়া ব্যবসা করে। সেখানে খাতাপত্রের দাম বেশি রাখা হয়।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২০২২ সালের পাঠ্যবইয়ের একটি তালিকা সারাবাংলার হাতে রয়েছে। নবম শ্রেণির প্রভাতী শাখার পাঠ্যবইয়ের তালিকায় দেখা যায় প্রতিটি বিষয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের ডিমাই সাইজ খাতার কথা বলা হয়েছে। অভিভবকরা বলছেন, মূলত এ কারণেই নির্দিষ্ট লাইব্রেরি থেকে তাদের খাতা কিনতে হচ্ছে। আর দোকানিরা দাম নিচ্ছেন বেশি। তালিকার একদম নিচের অংশে লেখা রয়েছে- ‘ডায়েরি স্কুল থেকে নিতে হবে।’ বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে লেখা রয়েছে, ‘স্কুলে নির্ধারিত পোশাক রং এর সামঞ্জস্য রক্ষার্থে প্রত্যেক ছাত্রীকে স্কুল থেকে ইউনিফর্ম ক্রয় করতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই এটি চলে আসছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। আমাদের এখানে একটি রুমে স্কুল ড্রেস বিক্রি হয়। যার ইচ্ছা সেখান থেকে ড্রেস বানিয়ে নেয়। এটি স্কুলের কোনো ব্যবসা নয়। মেয়েদের দরকার। তারা এক জায়গা থেকে পাচ্ছে। কেউ বানাতে চাইলে বানায়। না বানাতে চাইল বাধ্যবাধকতা নেই। কালার বা রং একই রকম হওয়ার কারণে সাধারণত তারা স্কুলের ভেতর থেকেই ড্রেস বানিয়ে থাকে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘খাতা-কলম বা অন্যান্য উপকরণ কেনার জন্য আমরা কোনো লাইব্রেরি নির্ধারণ করে দিইনি। হয়ত কেউ কেউ স্কুলের মনোগ্রাম দিয়ে খাতা তৈরি করে বিক্রি করে, যাতে মেয়েরা আকর্ষিত হয়। কিন্তু আমরা লাইব্রেরি নির্ধারণ করে দিইনি।’
রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নিজস্ব ভবনেই দেখা গেছে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব বুক স্টল। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব খাতাও রয়েছে। রেহানা সুলতানা নামের একজন অভিভাবক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে ৫ম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলের ভেতরেই ড্রেস বিক্রি করা হয়, সেখানে প্রতি শার্ট বা প্যান্টের দাম বাইরের চেয়ে ১০০ টাকা বেশি। স্কুলের ডায়েরি, ভর্তির সময় একসেট খাতা তাদের লাইব্রেরি থেকেই নিতে হয়। বাইরের চেয়ে সেখানে দাম অনেক বেশি।’
সরেজমিনে প্রতিষ্ঠানটিতে গেলে বুক স্টলে থাকা একজন জানান, এটি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নিজস্ব দোকান। এখানে স্কুলের খাতা কলম ও স্টেশনারি সামগ্রী পাওয়া যায়।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির ১১৬ নম্বর রুমে স্কুল ও কলেজ ড্রেস তৈরি হয়। তবে গেল সোমবার (১৪ নভেম্বর) দুপুর দুইটার দিকে গিয়ে ওই রুমটি বন্ধ পাওয়া যায়। মন্তব্য জানতে সাংবাদিক পরিচয়ে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
একইদিনে, নটরডেম কলেজে কথা হলে কয়েকজন ছাত্র সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, কলেজটির নিজস্ব বুক স্টল রয়েছে। তবে সেখান থেকে খাতা-কলম ও বই কেনা বাধ্যতামূলক নয়। রাগিব নামের ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্র সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইউনিফর্মের কাপড় ভেতর থেকে নিতে হয়। বাইরের যে কোন টেইলার্স থেকে বানানো যায়। ভর্তির সময় যে টাকা নেওয়া হয় তারমধ্যেই স্কুল ব্যাগ ও ইউনিফর্মের কাপড়ের টাকা যুক্ত থাকে।’
হাসান নামের দ্বিতীয় বর্ষের আরেক ছাত্র সারাবাংলাকে বলেন, ‘কলম, বই, খাতা কলেজের ভেতরে থাকা লাইব্রেরি থেকে কিনতে হয়। তবে কলেজ ইউনিফর্ম যে কোনো টেইলার্স থেকে বানানো যায়।’
বনশ্রী মডেল স্কুলের সাবেক ছাত্র বর্তমানে নটরডেমে পড়ুয়া রিয়াদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি যে স্কুলে পড়তাম সেখানে এসবের ব্যাপারে অনেকটাই বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু এখানে নেই। ভর্তির মধ্যেই কাপড় ও ব্যাগের টাকা ইনক্লুড থাকে। তখন এই কাপড় ও ব্যাগটা দেওয়া হয়। টেইলার্স নির্দিষ্ট থাকে না।’ তবে এসব বিষয়ে নটরডেম কলেজের অধ্যক্ষের মন্তব্য জানতে পারেনি সারাবাংলা।
রাজধানীর সিভিল এভিয়েশন স্কুল অ্যান্ড কলেজে কথা হলে রবিউল আলম নামের একজন অভিভাবক সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই স্কুলে আমার তিন ছেলে মেয়ে লেখাপড়া করে। ওয়ান, কেজি ও ফাইভে তারা পড়ছে। অভিজাত নামের একটি নির্দিষ্ট টেইলার থেকে ছেলে মেয়েদের ড্রেস কিনতে হয়। কাপড়ের মান খারাপ কিন্তু দাম বেশি। নির্দিষ্ট ওই দোকান থেকেই কাপড় বানাতে হয়। যে কাপড় তিনশ টাকা দিয়ে কিনি, সেটি অন্য জায়গা থেকে অনায়াসে ১০০ টাকায় কেনা যেত। আর সাদা শার্ট বা সাদা ড্রেস দিচ্ছে, সেটি যে কোনো দোকান থেকেই বানানো যেত। তারা কেবলমাত্র লোগো লাগিয়ে দিতে পারত কিংবা বিক্রি করতে পারত। আমাদের ধারণা স্কুল কর্তৃপক্ষ হয়তো দোকান থেকে কমিশন পায়। নতুবা একটি দোকান তো নির্দিষ্ট করে দেওয়ার কথা না। এই অভিভাবক স্কুলটির ক্যান্টিনের খাবারের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বলেন, ‘এখানে যে খাবারের দাম ৫০ টাকা রাখা হয়, সেটি বাইরে থেকে কিনলে ২৫ টাকায় কেনা যেত। ক্যান্টিনে প্রায় দ্বিগুণ দাম প্রতিটি খাবারের।’
একই রকম কথা বলেন আনোয়ার হোসেন নামের আরেক অভিভাবক। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিজাত নামের একটি টেইলার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সেখান থেকে যে কাপড় দেওয়া হয়, তার গুণগত মান খারাপ, কিন্তু দাম বেশি। আমাদের দাবি, কাপড় বা ড্রেস যাতে যে কোন দোকান থেকে বানানো যায় সেই ব্যবস্থা যেন করা হয়। কেবলমাত্র তারা লোগো বিক্রি করবে।’
নাজনীন নামের একজন অভিভাবক জানান, তার ছেলে নির্ঝর ক্যান্টম্যান্ট স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। স্কুলের ভেতরেই টেইলার্স রয়েছে। সেখানে থেকেই ড্রেস বানাতে হয়।
তিনি বলেন, ‘স্কুল থেকেই আমরা ড্রেস বানাই। কারণ স্কুলের মনোগ্রাম থাকে। ফলে সেখান থেকেই বানাতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘খাতাও স্কুলের নিজস্ব লাইব্রেরি থেকে কিনতে হয়। একেক বিষয়ের জন্য একেক ধরনের খাতার রং নির্ধারিত থাকে। ফলে স্কুলের মনোগ্রামযুক্ত খাতা তাদের লাইব্রেরি থেকেই কিনতে হয়। বছরের প্রথম দিকে একসেট কিনি, পরে যখন যে খাতা শেষ হয়, তখন সেটি কিনি।’
মন্তব্য জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমত এটি অনৈতিক চর্চা। এটি চলতে পারে না। এটি বন্ধ করা উচিৎ। সরকারকে অবিলম্বে এটি বন্ধ করতে হবে। না হলে এটি দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। অভিভাবসহ সকলের এ বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করা উচিৎ।’
তিনি বলেন, ‘এর বিকল্প হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ছোট ছোট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি দিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে ইউনিফর্ম সরবরাহ করা। অঞ্চলভেদে যে কোনো একটি ছোট গার্মেন্টসকে নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে এবং সরকার এক্ষেত্রে ভর্তুকি দেবে। শিক্ষার্থীদের কাছে স্বলমূল্যে যেমন ১০০ টাকায় তা সরবরাহ করা যেতে পারে। বিশেষ দর্জিকে এই কাজ দেওয়া উচিৎ না। যেহেতু শিক্ষার্থীদের জোরাজুরি করা হচ্ছে, হয়তো স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের দেন দরবার হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্কুলের মনোগ্রামযুক্ত খাতার ক্ষেত্রে কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্পন্সর করতে পারে এবং তা বিনামূল্যে সরবরাহ করা যেতে পারে।’
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই বাণিজ্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমাদের কোনো নিয়ম নেই। এটি স্কুল-কলেজের নিজস্ব ব্যাপার। এ নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই।’
সারাবাংলা/ইএইচটি/রমু