আসছে অসাম্প্রদায়িক ও জেন্ডার সংবেদনশীল পাঠ্যক্রম
২৪ নভেম্বর ২০২২ ১০:১৭
ঢাকা: ২০২৩ সাল থেকে শুরু হতে যাওয়া শিক্ষাক্রমে বদলে ফেলা হচ্ছে শিক্ষাপদ্ধতি, পাঠ্যবই, মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সবই। নতুন পাঠ্যপুস্তক হতে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত ও জেন্ডার-সংবেদনশীল। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবইকে আধুনিক, যুগোপযোগী, সংবেদনশীল ও অসাম্প্রদায়িক করতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পর্যবেক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সারাবাংলাকে একথা নিশ্চিত করেছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
তিনি বলেন, লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে আন্তর্জাতিক কমিটমেন্ট রয়েছে তা মাথায় রাখা হয়েছে। কোন বিষয়ের মাধ্যমে যেন জেন্ডার পরিচিত প্রোথিত না হয় সেটি মাথায় রেখে সাজানো হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের মাধ্যমে মেয়েরা ঘরের কাজ করবে আর ছেলেরা কৃষিকাজ সেটি যেন কারও মাথায় না ঢোকে তা লক্ষ্য রাখা হয়েছে। বয়সসীমা অনুযায়ী সব মানুষকেই যে সব কাজ করতে হবে তা মাথায় রেখেই কাজ করেছি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) ও সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষা) মো. মশিউজ্জামান বলেন, জেন্ডার বিষয়ে রিভিউ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার বিভাগের শিক্ষক। আবার সামগ্রিকতা রিভিউ করেছেন আইইআর-এর একজন শিক্ষক। প্রতিটি পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে পরিমার্জন বা পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন পাঠ্যপুস্তকে শুধু নারী-পুরুষই নয়, ট্রান্সজেন্ডারদের (ভিন্ন লিঙ্গ) বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে সমাজে যেসব ভুল ও অস্পষ্ট ধারণা আছে সেগুলো কাটানোর জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ট্রান্সদের নিয়ে কাজ করে এমন ব্যক্তিদের মতামতের উপর ভিত্তিতে কন্টেইন্ট তৈরি করা হয়েছে।
অন্যদিকে পাঠ্যবইয়ে ধর্মশিক্ষা নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে উপমন্ত্রী বলেন, এটা আফগানিস্তান না, এটা বাংলাদেশ। এখানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিষয়ই পড়ানো হবে। আমরা মনে করছি না, ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু এখানে আছে। কিছু কিছু গোষ্ঠী পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িকতা, অসাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। আবার অনেকেই ধর্মশিক্ষাকে গুরুত্ব কম দেওয়া হবে এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু আমরা শুধু ধর্মশিক্ষা না, আমরা পরীক্ষার মূল্যায়নের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে চাই। সেই লক্ষ্যেই শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন করা হয়েছে। কিছু কিছু বিষয়ে মার্ক দেওয়ার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসবে। মুখস্ত প্রক্রিয়া থেকে সরে আসা হচ্ছে। ধর্মশিক্ষার ক্ষেত্রেও মুখস্থর বাইরে এসে নৈতিকতার চর্চা কতটুকু করতে পারছি সেটাতে গুরুত্ব দিচ্ছি।
২০১৭ সালের পয়লা জানুয়ারি বই উৎসবের পরপরই বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বানান ভুল, বিভ্রান্তিকর ও তথ্যবিকৃতির অভিযোগ ওঠে। এছাড়াও বাদ যায় বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা অনেক সাহিত্যিকের লেখা। সেসময় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসে হেফাজত ইসলাম ও আরও কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের দাবির প্রেক্ষিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘হিন্দুত্ববাদী’ ও ‘নাস্তিক্যবাদী’ লেখা বাদ দেওয়া হয়। হেফাজত ইসলাম ও অন্যান্য কয়েকটি ধর্মিভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের দাবি ছিল এসব লেখা বাদ দিয়ে ইসলামি ভাবধারার রচনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের পাঠ্যবই থেকে বাদ পড়ে জ্ঞানদাস, ভারতচন্দ্র, লালন ফকির থেকে শুরু করে হুমায়ুন আজাদের মতো বরেণ্য লেখকদের লেখা। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সমালোচনা হলেও এই পাঠ্যবইকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেয় হেফাজতে ইসলাম।
২০১৭ সালে নতুন পাঠ্যবই আসার পর দেশের নানা জায়গায় তান্ডব চালায় হেফাজতে ইসলাম। এবারও তেমন কোন আশঙ্কা আছে কিনা জানতে চাইলে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, হেফাজতের কোন মাদরাসায় জাতীয় পাঠ্যক্রমের কোন বই পড়ানো হয় না। তাই যে পাঠ্যবই তারা পড়ায় না, সেটা নিয়ে তাদের তাণ্ডবের কোন মানে নাই। আলিয়া মাদ্রাসায় আমাদের বই পড়ানো হয়, তাই তাদের আলোচনা-সমালোচনা শুনি আমরা। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষককে দিয়েও পাঠ্যবই পর্যালোচনা করিয়েছি। মাদ্রাসা শিক্ষকদের সঙ্গে পাইলটিং করা হয়েছে। এখন তারা যদি গো ধরে বসে থাকে যে তারা অনেক কন্টেন্ট পড়বে না, তা তো হতে পারে না। রাষ্ট্রের একটি দায়িত্ব আছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান, লিঙ্গ সমতার বিষয়টি তাদের পড়তেই হবে। বিশ্বাস-অবিশ্বাস ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু জ্ঞানার্জন করতেই হবে। তারপর জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে ব্যক্তি তার জীবন পরিচালনা করবে। এর মানে এই না যে আমরা শেখাবোই না।
এর আগে ১৯৭২ সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে সংবিধানের বর্ণিত রাষ্ট্রের চার মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে শিক্ষার মূলনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরে ১৯৭৮ সালে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে ধর্মশিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করার পর ধর্ম ও নৈতিকতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ১৯৯৭ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও অসাম্প্রদায়িকতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ২০০৩ সালে গুরুত্ব পায় ধর্মীয় নৈতিকতা আর ২০০৭ সালে অসাম্প্রদায়িকতা গুরুত্ব পেলেও চার মূল নীতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
জানা যায়, ২০২৩ সাল থেকে চালু হতে যাওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে বিষয়বস্তু ঢেলে সাজানো হচ্ছে। বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে অভিজ্ঞতামুখী কারিক্যুলাম সাজানো হয়েছে। এখানে সব বিষয়েই বিশেষজ্ঞ, পেডাগোজি বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মতামতের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে মশিউজ্জামান বলেন, জেন্ডারের ক্ষেত্রে সব কাজই যে সবার সেটি তুলে ধরা হয়েছে। জীবন ও জীবিকা নামক বিষয়টিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবই প্রি-ভকেশনাল ধরনের আর নবম এবং দশম শ্রেণিতে এটি ভকেশনাল রূপ নেবে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির জীবন ও জীবিকা বইয়ে প্রতিটি শিশুর জন্য একই কাজ নির্ধারণ করা হয়েছে। শিশুরা শ্রেণিকক্ষে বলবে বাসায় সে কী কী কাজ করে। সেখানে অভিভাবকদের মূল্যায়নের জন্যও পাতা আছে যেখানে অভিভাবক বলবে তাদের সন্তান বাসায় কী কী কাজ করে। এর আগে মেয়েরা গার্হস্থ্য বিজ্ঞান আর ছেলেরা কৃষি বিজ্ঞান পড়বে এমন একটি অলিখিত নিয়ম থাকলেও এখন আর এসব বিষয়ই থাকছে না।
মাধ্যমিক পর্যায়ে ধর্ম শিক্ষা ছাড়া বাকি নয়টি বিষয়ের পাঠ্যবই সবার জন্য একই। এছাড়াও প্রতিটি বিষয়ই একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অর্থাৎ ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি নিয়মে থাকবে। মশিউজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্মশিক্ষা থাকলেও সব ধর্মের পাঠ্যবইয়ে ধর্মীয় রীতিনীতি বিষয় থাকার পাশাপাশি থাকবে বিশেষ একটি অধ্যায়। এই অধ্যায়ে প্রতিটি ধর্মের বিধিবিধান অনুযায়ী অন্যান্য ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
নতুন পাঠ্যক্রমে জেন্ডার-সংবেদনশীলতা রিভিউ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ড. সানজিদা আখতার। তিনি বলেন, মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শ্রেণির সবগুলো বই রিভিউ করে কোথাও কোন সমস্যা পাননি। যেসব রিভিউ দিয়েছেন সেগুলো গুউরত্ব সহকারে বিবেচনা করে পরিমার্জন করা হয়েছে। নতুন পাঠ্যক্রম সকল জেন্ডারের জন্য সম্মানজনক হয়েছে।
ইনক্লুসিভিটি বা সামগ্রিকতার রিভিউকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনপ্রক্রিয়ায় মূলত শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই থেকেই শিখবে না, তারা নিজেরাই বিভিন্ন জিনিস নানান মাধ্যমে খুঁজে দেখবে। এখানে শেখার মাধ্যম শুধুমাত্র পাঠ্যবই নয়, বরং একাধিক মাধ্যম। সমাজ, প্রকৃতি, আশপাশের পরিবেশ, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি, অন্যান্য বই থেকেও তথ্য সংগ্রহ করতে হবে তাদের।
এদিকে, সম্প্রতি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্ন বিতর্কের জন্ম দেয়। এখানে নারী, লেখক ও ধর্মবিদ্বেষ চোখে পড়ে। মশিউজ্জামান বলেন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সময় এটি বারবার করে বলে দেওয়া হচ্ছে যেন তারা কোন প্রশ্ন করার সময় ব্যক্তিগত মতাদর্শের প্রয়োগ না ঘটান।
নতুন পাঠ্যক্রম সম্পর্কে ইতিবাচক আশাবাদ ব্যক্ত করে শিক্ষাবিদ ও লেখক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার আধুনিকায়ন আমাদের অনেক দিনের দাবি ছিল। দেখা যায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী ও দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক না হয়ে মুখস্তবিদ্যা নির্ভর হওয়ায় বেসরকারি পর্যায়ে উপরের দিকের পদে বিদেশ দেশ থেকে রিসোর্স আনা লাগে। এভাবে দেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছে। বর্তমান এই রিজার্ভ সংকটের সময়ে এই ছয় বিলিয়ন ডলারও কিন্তু অনেক। নতুন শিক্ষাক্রম ঠিকঠাকভাবে চালু করা গেলে এই সংকট দূর হবে বলেই আশা করা যায়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার প্রয়োগ ঘটাতে হবে যা বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতু হতে গেলে শিক্ষা বিষয়ে কোন রাজনৈতিক আন্দোলনের সামনে মাথা নত করা যাবে না।
সারাবাংলা/আরএফ/রমু