দেশের সবাই রিজার্ভ ও অর্থনীতিতে পারদর্শী হয়ে গেছে: শেখ হাসিনা
২৫ নভেম্বর ২০২২ ২১:১৭
ঢাকা: রিজার্ভ ও ব্যাংকে টাকা রাখা নিয়ে গুজব ছড়ানোর ব্যাপারে বিরক্তি প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কিছুদিন থেকে আমাদের দেশের সবাই রিজার্ভ সম্পর্কে এবং অর্থনীতি সম্পর্কে ভীষণভাবে পারদর্শী হয়ে গেছে। গ্রামে গ্রামে চায়ের দোকানেও রিজার্ভ নিয়ে কথা। জাতির পিতা তো যাত্রা শুরু করেছিলেন শূন্য রিজার্ভ নিয়ে। আমাদের এখন যে রিজার্ভ তাতে পাঁচ মাসের আমদানি করতে পারি। সে পরিমাণ অর্থ আমাদের কাছে আছে।
শুক্রবার (২৫ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) ৫ম সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ সব কথা বলেন। দুপুর ৩টার পর জাতীয় পতাকা ও স্বাচিপের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের মেয়াদে স্বাস্থ্য সেবা জনগণের দোরগোঁড়ায় পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করার ফিরিস্তি তুলে ধরেন সারাদেশ থেকে সম্মেলনে আসা আওয়ামীপন্থী চিকিৎসকদের সামনে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক গতিশীলতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য যেহেতু স্থির আছে। যেহেতু ২০০৮’এর নির্বাচনে ইশতেহার দিয়েছিলাম রূপকল্প-২০২১। আমরা কিন্তু সেটা অর্জন করে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। এই মর্যাদা ধরে রেখে ২০৪১’এর মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে আমরা গড়ে তুলব। সেটিই আমাদের লক্ষ্য।’
জাতির পিতা স্বল্পোন্নত দেশ রেখে গিয়েছিলেন আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। আমাদের যে উন্নয়নের গতি প্রবৃদ্ধি একমাত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আমলে আমাদের প্রবৃদ্ধি নয় ভাগের উপরে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। তারপরে আর হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পরে আমরা ৮ ভাগ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছিরাম। কিন্তু দুভার্গ্যের বিষয় কোভিড-১৯ এসে আমাদের সেই উন্নয়নের গতিটাকে শ্লথ করে দেয়। তারপরও চেষ্টা করে যাচ্ছি আমাদের উন্নয়নের ধারাটা যেন অব্যাহত থাকে। সেইজন্য আমাদের প্রচেষ্টা আছে। আমরা কিছু অগ্রগতিও পাচ্ছি বলে মনে করেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ তার উপর আমেরিকার স্যাংশন, ইউরোপের স্যাংশন কাউন্টার স্যাংশন যার ফলে আজকে প্রত্যেকটা জিনিস আন্তর্জাতিক বাজারে অত্যাধিক মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে বলেও অবহিত করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘গ্রেট ব্রিটেন তাদের অর্থনৈতিক মন্দা ঘোষণা দিয়েছে। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশই কিন্তু মন্দা দ্বারা আক্রান্ত। সেখানে সবাইকে আহ্বান করেছি যেন কৃচ্ছ্বতাসাধন করে, সবাইকে একটু সাশ্রয়ী হতে হবে।’ বিদ্যুৎ পানি খাদ্য কোন অপচয় যেন না হয়। সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান প্রধানমন্ত্রী।
রিজার্ভ নিয়ে গুজব ছড়ানোর কারণে বিরক্তি প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিছুদিন থেকে শুনলাম আমাদের দেশের সবাই রিজার্ভ সম্পর্কে এবং অর্থনীতি সম্পর্কে ভীষণভাবে পারদর্শী হয়ে গেছে। গ্রামে গ্রামে চায়ের দোকানেও রিজার্ভ নিয়ে কথা। সেখানে আমার কথা হচ্ছে, জাতির পিতা তো যাত্রা শুরু করেছিলেন শূন্য রিজার্ভ নিয়ে। তিনি তো এদেশটাকে গড়ে তুলেছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে যখন সরকার গঠন করি বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। রিজার্ভ রেখে গিয়েছিল ২ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। আমরাই উদ্যোগ নিয়ে সেই রিজার্ভ কিছুটা বাড়াই।
২০০১’ এর নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০০১ এর নির্বাচনে তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সিস্টেম ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার আমরা কিন্তু খুব শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করি। বাংলাদেশের সার্বিক চিত্রটা যদি দেখেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ওই একবারেই অর্থ্যাৎ স্বাধীনতার পর জাতির পিতা সংবিধান দিয়ে ১৯৭৩ সালে নির্বাচন দেন। ৭৫সালে জাতির পিতাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল। এই যে ক্ষমতা দখলের পালা শুরু। এরপরে কোনোদিনই বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার রদবদল হয়নি। প্রতিটি সময়েই কিন্তু হয় আমরা আন্দোলন করে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছি।’
এ সময় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফ্রেবুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন করার জন্য খালেদা জিয়াকে আন্দোলন করে পদত্যাগ করার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, ‘কাজেই আমরা কিন্তু সবসময় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চাই। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতাটা। আজকে ২০০৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। আমরা এই তৃতীয়বারের মতো এখন সরকারে। অন্তত এইটুকু দাবি করতে পারি এই ১৪ বছরে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। আমাদের দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে।’
রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু আমাদের দেশে না পৃথিবীর অনেক দেশেরই রিজার্ভ কমে গেছে। আমরা শ্রীলংকাকে কিছু সহযোগিতা করেছি। আরও অনেক দেশ কিন্তু ওই সহযোগিতার পর আমাকে অুনরোধ করেছে। আমি নাম বলতে চাই না। আমি তাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছি আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। কারণ এখন যেটুকু রিজার্ভ সেটা আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজন। সেটি আমাকে রাখতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রিজার্ভ রাখা লাগে কিসের জন্য? যদি কোনো দৈব-দুর্বিপাক হয় আমার তিন মাসের খাবার যেন আমি আমদানি করতে পারি। আর সে কারণে আমার যেন আমদানি করতে না হয় খাদ্যপণ্য যেন মোটেই আমদানি করতে না হয় তার জন্য আমি দেশের মানুষ সবাইকে আহ্বান করেছি। যার যেখানে যতটুকু জমি আছে আপনি এক ইঞ্চি জমি ফেলে রাখবেন না। যে যা পারেন উৎপাদন করেন। নিজেরটা নিজে করে খান। নিজে সাশ্রয় করেন। নিজের খাদ্য নিজে জোগান দেন এবং আমরা তা করতে পারি। কারণ বাংলাদেশের মানুষ পারে।’
জাতির পিতা যে কথা বলে গেছেন কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাংলাদেশের মানুষকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। আর বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত উৎসাহী। তাদেরকে একটু সুযোগ দিলে তারা কাজ করতে পারে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী।
রিজার্ভ আর ব্যাংকে টাকা রাখা নিয়ে গুজবের ব্যাপারে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন যে রিজার্ভ তাতে তিন মাস না, পাঁচ মাসের আমদানি করতে পারি। সে পরিমাণ অর্থ আমাদের কাছে আছে। তা ছাড়া একটা গুজব ছড়াচ্ছে। টাকা ব্যাংকে নাই, টাকা পাবে না। সবাই টাকা ব্যাংক থেকে তুলে ঘরে রাখে। ঘরে টাকা রেখে তো চোরকে সুযোগ করে দেওয়া, তাই না। চোরের পোয়াবারো। তারা জানবে ওই বাড়িতে টাকা আছে যাই চুরি করে। তাই চোরের হাতে তুলে দেবে না ব্যাংকে টাকা রাখবে সেটা টাকার মালিক যারা তাদের উপরেই নির্ভর করে।’
ভোগ্যপণ্যের কোনো অসুবিধা হবে না জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইউক্রেন রাশিয়া থেকেও আমরা আমদানি শুরু করেছি। যদিও স্যাংশনের কারণে ডলারে পেমেন্টের অসুবিধা। আমরা বিকল্প ব্যবস্থা কিভাবে করা যায় তার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি। লম্বা সময় বক্তব্য শোনার জন্য চিকিৎসকদের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, চিকিৎসকদের ধৈর্য আছে আমি জানি। আমাদের দেশের ডাক্তাররা অতিরিক্ত কাজ করে। তারা মানুষের সেবা দেয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা শেখ মুজিব এদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভিত্তিটা তৈরি করে দিয়ে গেছেন। সরকারে এসে কাজ করে যেয়ে আমি নিজেই বিস্মিত হই যেখানে কোন টাকা ছিল না। পয়সা ছিল না এই অবস্থার মধ্যেও তিনি এতো কাজ করে দিয়ে গেলেন। তার মনে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি যে গভীর ভালবাসা এবং দৃঢ়চেতা মনোভাব ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নের ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করেছে বলেও জানান। বক্তব্য দেওয়ার সময় স্লোগান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘স্লোগানটা একটু পরে, একটু বলে রাখি। শুনি যে আমরা নাকি কিছুই করিনি। তাই যখন যে সেক্টরে যাচ্ছি সেই সেক্টরে কিছু কাজ করেছি একটু মানুষকে জানানো দরকার। আসলে বাংলাদেশের মানুষ তো। ছয় ঋতুর দেশ। দুই মাস পর পর ঋতু বদলায়, পাখির ডাক বদলায়। পশু-পাখির কলতান বদলায়। বাতাসের গতি বদলায় মানুষের মনও বদলায়। আর যা কিছু করি ভুলে যায়। এই ভুলে যাতে না যায় তার জন্য মাঝে মাঝে একটু স্মরণ করাতে হয়। তাই যখন যেখানে যাই ওই সেক্টরে কি করলাম মানুষের কাছে একটু তুলে ধরি।’
বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দুপুর তিনটার পর জাতীয় পতাকা ও স্বাচিপের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন তিনি। স্বাচিপের মহাসচিব ডা. এম এ আজিজ সাংগঠনিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। স্বাচিপের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান।
২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর স্বাচিপের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হলেও ওইদিন কমিটি গঠনের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর ওপর ছেড়ে দিয়ে সম্মেলন স্থগিত করা হয়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান সভাপতি ও অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত হন। দলীয় গঠনতন্ত্র অনুসারে পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ২০১৮ সালের নভেম্বরে পরবর্তী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। মহামারি করোনার কারণে গোটা বিশ্ব থমকে যাওয়ার স্বাচিপের সম্মেলনের আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।
সারাবাংলা/এনআর/একে