ঢাবিতে প্রাইভেটকার চাপায় নারীর মৃত্যু—ভিসির বাড়ির সামনে বিক্ষোভ
২ ডিসেম্বর ২০২২ ২১:২৬
ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে প্রাইভেটকার চাপায় এক নারীর মৃত্যুর ঘটনায় উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেছে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন ও ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বহিরাগত যানবাহন নিয়ন্ত্রণের দাবি জানান।
শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) রাত ৮টার দিকে ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে অবস্থান নেন তারা।
এ সময় তারা ‘বেপরোয়া যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করো, প্রাইভেটকারের অভয়ারণ্য বন্ধ করো’, ‘ঢাবি ক্যাম্পাসে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করো’, ‘নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই’সহ বিভিন্ন লেখা সংবলিত প্লেকার্ড প্রদর্শন করেন।
এর আগে, বেলা সাড়ে তিনটার দিকে রুবিনা আক্তার নামক এক নারীকে প্রাইভেটকার চাপা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক আজহার জাফর শাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা থেকে চাকায় আটকে যাওয়া ওই নারীকে টেনেহিঁচড়ে নীলক্ষেত পর্যন্ত নিয়ে যান ওই শিক্ষক। পরে আহত ওই নারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার মৃত্যু হয়।
অবস্থান কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হল সংসদের সাবেক ভিপি শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি বলেন, ‘এ ধরনের দুর্ঘটনা নতুন নয়। আজকে যে নারী গাড়ি চাপায় মারা গেছেন, তার জায়গায় আমি থাকতে পারতাম। আমার কোনো ভাই বা বোন থাকতে পারত। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক-বর্তমান সকল শিক্ষার্থীদের প্রতি অনুরোধ করছি, আপনারা আওয়াজ তুলুন। যানবাহন নিয়ন্ত্রণের দাবি তুলুন।’
ছাত্র ফেডারেশন নেতা আরমানুল হক বলেন,‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো সংবলিত স্টিকার থাকে। আমরা স্পষ্ট দাবি জানাই, সেইসব গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি যেন এখানে প্রবেশ করতে না পারে। আমরা যতদূর জানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা বিকল্প রাস্তা ছিল। অথচ এখন এটি মূল সড়কে পরিণত হয়েছে। এখানে ট্রাক-বাস-লরি সবই চলে।’
ছাত্র অধিকার পরিষদ ঢাবি শাখার সভাপতি আখতার হোসেন বলেন, ‘আজকে যে ঘটনা ঘটেছে, সে ব্যাপারে আমাদের প্রক্টর যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা কেবল দায় এড়ানোর চেষ্টা মাত্র। তিনি বলেছেন, ওই চালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক। কিন্তু, আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থী সবার নিরাপত্তার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। অথচ এখানে কারা আসে, কারা যায় তা নিয়ে প্রশাসনের মাথাব্যথা নেই।’
যেভাবে নারীর মৃত্যু: প্রত্যক্ষদর্শী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী সারাবাংলাকে জানান, বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শাহবাগ থেকে মোটরসাইকেলযোগে আসছিলেন রুবিনা আক্তার। তার দেবর নুরুল আমিন মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন আর পেছনে বসা ছিলেন ওই গৃহবধূ।
এ সময় সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দিলে রুবিনা নিচে পড়ে যান। পরে গাড়ির সামনের দিকের বাম চাকায় আটকে পড়েন তিনি। ওই নারী চাকায় আটকা পড়া অবস্থাতেই চালক গাড়ি না থামিয়েই টিএসসি থেকে নীলক্ষেতগামী রাস্তার দিকে গাড়ি চালাতে থাকেন।
আশেপাশের প্রত্যক্ষদর্শীরা চিৎকার করে প্রাইভেটকারটি থামাতে বললেও চালক গতিরোধ করেননি। পরে কয়েকটি মোটরসাইকেল নিয়ে চালকের পিছু নেন শিক্ষার্থীরা। নীলক্ষেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণ-সংলগ্ন জায়গায় ট্রাফিক জ্যাম বাধায় প্রাইভেটকারটি সেখানে আটকা পড়ে।
পরে উপস্থিত জনতা প্রাইভেটকার চালক জাফর শাহকে গণধোলাই দেন।
এদিকে, টিএসসি থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত রাস্তায় প্রায় আধা কিলোমিটার জুড়ে বিভিন্ন স্থাকে রক্ত ও রুবিনার শরীরের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন অংশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।
যা জানান মোটরসাইকেল চালক: ওই নারীর দেবর নুরুল আমিন জানান, তাদের বাসা হাজারীবাগের সেকশন এলাকায়। তেঁজগাও থেকে ভাবীকে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে বাসার দিকে যাচ্ছিলেন। মোটরসাইকেলটি শাহবাগ মোড়ে এলে একটি প্রাইভেটকার তাতে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এতে তার ভাবী মোটরসাইকেল থেকে প্রাইভেটকারের সামনে ছিটকে পড়েন। তখন তার ভাবীর কাপড়চোপড় প্রাইভেটকারের সামনের বাম্পারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এরপরও প্রাইভেটকারটি না থেমে তার ভাবীকে টিএসসি হয়ে নীলক্ষেত পর্যন্ত টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায়।
শাহবাগ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ জানান, একটি প্রাইভেটকার নারীকে টেনে-হিঁচড়ে অনেক দূরে নিয়ে যায়। হয়ত তার পরনের জামাকাপড় ওই প্রাইভেটকারের সঙ্গে আটকে গিয়েছিল।পরে উত্তেজিত জনতা গাড়টি ভাঙচুর করে। এ সময় প্রাইভেটকারের চালক জাফর শাহ গণধোলাইয়ের কবলে পড়েন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. বাচ্চু মিয়া জানান, চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে। তার মরদেহ মর্গে পাঠানো হয়েছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রব্বানী জানান, ২০০৭/২০০৮ সালের দিকে নৈতিক স্খলনের কারণে ওই শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
শিক্ষার্থীদের ক্ষোভপ্রকাশ: ঘটনার একটি ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে মুখ খুলেছেন অনেক শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাতেমা কলি ফেইসবুকে লেখেন, ‘টেনে-হিঁচড়ে নেওয়া নারীটি আমিও হতে পারতাম। কিংবা আমার সহপাঠীদেরও কেউ হতে পারত। আমাদের এখনই আওয়াজ তোলা উচিত। অবশ্যই উচিত। ঢাবি কর্তৃপক্ষের উচিত নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা।’
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিত্যদিন গাড়ির চাপ থাকার বিষয়কে হুমকি মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দীন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আবু রায়হান লেখেন, ‘এই যে রাত ১টায় ব্রাজিলের ম্যাচ পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে যাবে একখানা চিড়িয়াখানা। সঙ্গে আরও থাকবে উচ্চগতির বাইক এবং গাড়ি। হর্ন বা অন্যান্য আওয়াজের কথা বাদই দিলাম। এইটি শুধুমাত্র খেলার জন্যই না। স্বাভাবিক দিনেই মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসে যানজট পড়ে যায়। আজকের ভিকটিমের জায়গায় কাল আপনি বা আমিও থাকতে পারি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে প্রক্টোরিয়াল টিমের এই ব্যাপারে কোনো মাথা ব্যথা নেই। মাঝেমধ্যে মনে হয় এইটা একটা বিশ্ববিদ্যালয় না, এটি আসলেই একটা চিড়িয়াখানা।’
ওই শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘শুক্রবার আর শনিবার এই ক্যাম্পাসকে গুলিস্তান থেকে আলাদা করার কোনো উপায় নেই। কিছু কিছু জায়গা (টিএসসি) তো গুলিস্তানের থেকেও বেশি জনবহুল। ক্যাম্পাসে যারা উচ্চগতির যানবাহন চালাচ্ছেন, তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউই না।’
সারাবাংলা/আরআইআর/একে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাবি নিরাপদ ক্যাম্পাস ভিসির বাড়ি সড়ক দুর্ঘটনা