ফারদিনের মৃত্যুর তদন্তে সন্তুষ্ট বুয়েট শিক্ষার্থীরা
১৭ ডিসেম্বর ২০২২ ২০:৩৩
ঢাকা: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী নূর পরশের ‘আত্মহত্যার’ ঘটনায় ডিবি ও র্যাবের তদন্ত সন্তোষজনক বলেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এই মুহূর্তে নতুন কোনো পদক্ষেপে নেবেন না বলে জানিয়েছেন তারা। তারা বলছেন, ডিবি ও র্যাবের সঙ্গে বৈঠকের পর, তাদের সামনে উপস্থাপন করা ডিজিটাল ফুট প্রিন্ট বা প্রমাণসাপেক্ষে আর কোনো প্রশ্ন তাদের নেই। এ ছাড়া তাদের করা পাঁচটি প্রশ্ন ও ডিবি-র্যাবের জবাব নিয়েও বিস্তারিত জানিয়েছেন তারা।
শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বুয়েট শহীদ মিনারের সামনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজন পর্যায়ক্রমে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন।
বক্তব্যের শুরুতেই তারা জানান, ডিবি ও র্যাবের সঙ্গে বৈঠকের পর বুয়েটের সকল শিক্ষার্থীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তারা একটি সভা করে। সবার আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্মিলিত প্রতিক্রিয়াই তাদের আজকের বক্তব্য।
ডিবি ও র্যাবের সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে তারা জানায়, আপাতত তাদের আর কোনো কর্মসূচি নেই। তবে ফারদিনের পরিবার যদি আইনি প্রক্রিয়ায় যায়, তাহলে তাদের সহায়তা থাকবে।
এর আগে, ডিবি ১৪ ডিসেম্বর ফারদিন ‘আত্মহত্যা’ করেছে জানালে পরদিন মানববন্ধনের ডাক দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে সেদিনের মানববন্ধন স্থগিত করে ‘আত্মহত্যার প্রমাণ’ দেখতে ডিবি কার্যালয়ে ফারদিনের সহপাঠীরা। পরদিন ১৬ ডিসেম্বর র্যাবের আহ্বানে তাদের সঙ্গেও একটি বৈঠক করেন শিক্ষার্থীরা।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘বুধবার যখন ডিবি বলেছিল, এটি আত্মহত্যা, তখন আমরা বলেছিলাম, এটি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এতদিন হত্যাকাণ্ড বলে এখন আত্মহত্যা বলাটা আমাদের কাছে কোনোভাবেই যৌক্তিক মনে হচ্ছিল না। ১৪ তারিখ ডিবির মন্তব্য আসার পর, বুয়েটের ছাত্র কল্যাণ পরিদফতর থেকে বলা হয়, প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে যেন ডিবিকে জানানো হয়। তাদের সঙ্গে যেন বসি এবং তথ্য প্রমাণাদি দেখে নিই।’
পরে, ডিবির সঙ্গে বৈঠক করতে একদল শিক্ষার্থী মিন্টু রোডের ডিবি অফিসে যান। শিক্ষার্থীরা জানান, ওই সময় ডিবির কাছে মূলত চারটি প্রশ্ন করেন তারা। অন্য একটি প্রশ্ন র্যাবের কাছে করেন তারা। ওই প্রশ্নগুলোর উত্তরে ডিবি ও র্যাব কী বলেছেন তাদের—সেই বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা জানায়, ডিবির কাছে করা তাদের প্রথম প্রশ্ন ছিলো—ময়নাতদন্তের পর ডাক্তার জানিয়েছিল, ফারদিনের বুকে ও মাথায় অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল। তবে এখন কীভাবে আত্মহত্যার আলাপ এলো?
প্রশ্নের উত্তরে ডিবি তাদের জানায়, ডাক্তারের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন। ডাক্তার তাদের বলেছেন, এই আঘাতের ধরনটা অনেকটা কিল-ঘুষির মতো। এখানে কোনো কাটাছেঁড়ার বিষয় ছিল না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি ছিল রক্ত জমাট বাঁধার মতো। জামা-কাপড় ছিঁড়ে যায়নি। ডাক্তার বলেন, উপর থেকে লাফ দেওয়ার পর সেতুর স্প্যানে ধাক্কা খেয়ে কিংবা পানিতে লাফ দেওয়ার কারণেও এই ধরনের আঘাতের চিহ্ন আসতে পারে। সুতরাং, ওই চিহ্নের ওপর ভিত্তি করে ডাক্তারও বলছেন যে, এটি যে আত্মহত্যা নয়, তা শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না।
ডিবির কাছে করা তাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিলো—সিসিটিভি ফুটেজ থেকে ডিবি যে দাবি করছিলো, সেই লোকটাই ফারদিন, এর ভিত্তি কোথায়?
জবাবে ডিবি জানায়, ফারদিনের শেষ কন্ট্রাক্ট পাওয়া গেছে, যাত্রাবাড়ী থেকে লেগুনায় উঠতে দেখা যায় ফারদিনকে। সেই লেগুনা তাকে তারাব’র দিকে অর্থাৎ সুলতানা কামাল ব্রিজের বিপরীত পাশে নামিয়ে দেয়। ফারদিনের লোকেশন, ওই লেগুনা ড্রাইভারের লোকেশন—এগুলো ক্রসচেক করে ডিবি প্রমাণ পেয়েছে যে, বিষয়টি সত্য। ফারদিন যে জায়গা থেকে লাফ দেয়, সেই জায়গা থেকেই তার লোকেশন ট্র্যাক করা হয়।
ডিবি মনে করছে, ওই একই সময়ে, একই জায়গা থেকে অন্য একজনের লাফ দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এ ছাড়া ওই সময়ের পরই ফারদিনের মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। এর ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর ফারদিনের হাতঘড়িও বন্ধ হয়ে যায়।
ডিবির কাছে করা শিক্ষার্থীদের তৃতীয় প্রশ্ন ছিলো—ফারদিন যে সেদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, তার কোনো উপযুক্ত প্রমাণ আছে কি না?
জবাবে ডিবি জানায়, ওইদিন রাত ১০টা ৪৫ থেকে ১১টা ৯ মিনিট পর্যন্ত বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ফারদিনের কথা হয়। সেই কথোপকথনের সময় ফারদিনকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে। ট্র্যাক করা তথ্য বলছে, ওই সময় ফারদিন ছিল জনসন রোডে। অর্থাৎ, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর যে ট্র্যাকটা আমরা দেখেছি, ওই সময়টির মধ্যেই সেটি ছিল। ঘুরতে ঘুরতেই সে ফোনে কথা বলেছে এবং কথার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি।
এরপর ১টা ৫৭ থেকে ১টা ৫৯ পর্যন্ত তার একজন বন্ধুর সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা হয়। সেই বন্ধুর চ্যাট দেখে সেখানেও অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি।
শিক্ষার্থীদের চতুর্থ প্রশ্ন ছিলো—লেগুনা ড্রাইভার কতদিন আগে ফারদিনকে নামিয়ে দিয়েছিল, তা সে কীভাবে মনে রেখেছে?
উত্তরে ডিবি জানায়, ওই লেগুনা ড্রাইভারকে আটকের আগে পুলিশ তাকে নজরদারির মধ্যে রেখেছিল। প্রথমত, তার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক আচরণ পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, আটকের পর লেগুনা ড্রাইভার ঠিক কতজন নিয়ে যাত্রা করেছিল, সে ব্যাপারে হুবহু কিছু বলতে পারেনি। কারণ, ঘটনা অনেকদিন আগের। তবে সে বলেছে, মোটামুটি ৫/৬ জন ছিল। তারাব’র ওইখানে, অর্থাৎ ব্রিজের ওই পাড়ে বাজারের কাছে অল্প দূরত্বের দুটো ভিন্ন স্থানে দুইজনকে নামিয়ে দেয়। ডিবির ধারণা, ওই দুইজনের একজন ফারদিন। এ কারণে লেগুনা ড্রাইভারের সাক্ষ্যকে তারা খুব বেশি একটা সন্দেহ করছে না। লেগুনা ড্রাইভারের কথার সঙ্গে টাইমিং পুরোপুরি মিলে গেছে।
শিক্ষার্থীদের পঞ্চম ও সর্বশেষ প্রশ্ন ছিল—মাদক, চনপাড়া বস্তিসহ বিভিন্ন ঘটনা যে সামনে এলো, এগুলোর ভিত্তি কী?
এই প্রশ্ন প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা জানায়, তারা মূলত ডিবির কাছে এই পয়েন্টে প্রশ্ন করার সুযোগ পায়নি। কারণ, এই বিষয়গুলো নিয়ে ডিবি থেকে আগে কিছু জানানো হয়নি। পরে র্যাবের কাছে যাওয়ার পর এইগুলো নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ হয়।
এই প্রশ্নের উত্তরে র্যাব জানায়, তারা যখন প্রথম তদন্ত করা শুরু করে, তখন ৩টি জায়গা থেকে তদন্ত শুরু করে। ১. পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড কি না ২. দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু কি না ৩. আত্মহত্যা কি না। তদন্ত শুরু করার পর ফারদিনের রবি সিমের নম্বর ট্র্যাক করে যে এমন একটি সেলে তার লোকেশন কানেক্ট হয়ে যায়, যা মূলত চনপাড়ার বেশিরভাগ এলাকা এবং সুলতানা কামাল ব্রিজের অংশবিশেষ কাভার করে। ওইসব ভিত্তিতে র্যাব চনপাড়া এলাকা টার্গেট করে। ওই সময়, চনপাড়া থেকে অনেক সন্ত্রাসী এসে দাবি করে, তারা ফারদিনকে হত্যা করেছে। সেই জায়গা থেকে র্যাব তাদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সেক্ষেত্রে র্যাব তদন্ত করে কিছু না পেলে, সুলতানা কামাল ব্রিজ সংলগ্ন এলাকার দিকে ফোকাস করে।
আরও পড়ুন
স্বেচ্ছায় নদীতে ঝাঁপ দেয় ফারদিন: র্যাব
ফারদিনের হত্যাকারী টেকনোলজিক্যালি এক্সপার্ট: ডিবি
হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেছেন বুয়েট ছাত্র ফারদিন: ডিবি
ফারদিন হত্যার ঘটনায় এখনও অকাট্য প্রমাণ মেলেনি: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
সারাবাংলা/আরআইআর/একে
ডিবি ফারদিন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট শিক্ষার্থী র্যাব