মা থেকে নবজাতকের দেহে নিপাহ ভাইরাসের অ্যান্টিবডি
২৪ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:৪০
ঢাকা: প্রথমবারের মতো মা থেকে সন্তানের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসের অ্যান্টিবডি বা সম্ভাব্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রবাহের প্রমাণ মিলেছে। সম্প্রতি আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী এবং সহযোগীদের একটি নতুন গবেষণার ফলাফল ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
এই গবেষণা প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তি থেকে অন্যজনে সম্ভাব্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রবাহের নতুন তথ্য প্রদান করা হয়েছে। গবেষণাটি করেছেন আইসিডিডিআর,বির (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ) বিজ্ঞানী এবং সহযোগীরা।
গবেষণা প্রসঙ্গে প্রধান গবেষক ও আইসিডিডিআর,বির ইনফেকশাস ডিজিজেস ডিভিশনের অন্তর্গত ইমার্জিং ইনফেকশন্স শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট সায়েন্টিস্ট ড. সৈয়দ মইনুদ্দীন সাত্তার বলেন, ‘আমাদের জানা মতে এই গবেষণাই প্রথম নিপাহ ভাইরাসভিত্তিক ইমিউন প্রপার্টিজের ভার্টিকেল ট্রান্সফার বা মা থেকে শিশুতে পরিবাহিত হওয়ার প্রমাণ নিশ্চিত করে।’
তিনি বলেন, ‘ভাইরাস নিউট্রিলাইজেশনের কার্যকারিতা এবং নবজাতকের সুরক্ষার সম্ভাব্যতার বিষয়ে আরও গবেষণা করা প্রয়োজন। এটি নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধে গর্ভবতী ও কম বয়সী নারীদের জন্য টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে একটি রেফারেন্স হিসেবেও কাজ করবে বলে আমি আশাবাদী।’
আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ জাতীয় নিপাহ সার্ভেইল্যান্সের প্রশংসা করে বলেন, ‘আইসিডিডিআর,বি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শনাক্তকরণ, রোগের সংক্রমণের ধরন এবং মারাত্মক সংক্রমণের বিরুদ্ধে থেরাপিউটিকস এবং ভ্যাকসিন তৈরিতে নতুন তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহে বিশ্বের দীর্ঘতম নিপাহ ভাইরাস সার্ভেইল্যান্স পরিচালনা করছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি সফল প্রচেষ্টা এবং আমি আশা করি আমরা শিগগিরই নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং চিকিৎসা বের করতে পারব যা অনেক মানুষের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হবে।’
আইসিডিডিআর,বি জানায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ফরিদপুর জেলায় পাঁচ বছরের কম বয়সী একটি মেয়ে এবং তার মা নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়। তাদের উভয়েই খেজুরের কাঁচা রস পান করেছিল। দুঃখজনকভাবে শিশুটি মারা যায় এবং মা গুরুতর স্নায়বিক জটিলতার শিকার হন। ২০২১ সালের নভেম্বরে তিনি আবার গর্ভধারণ করেন এবং তিনি প্রসবের পূর্বে জাতীয় নিপাহ সার্ভেইল্যান্স কর্তৃপক্ষের নিবিড় তত্ত্বাবধানে সেবা পেয়েছেন। ২০২১ সালের আগস্টে তিনি একটি সুস্থ ছেলে শিশুর জন্ম দেন। রুটিন সারভাইভার ফলোআপের অংশ হিসেবে নবজাতকের দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং ভার্টিকেল ট্রান্সমিশন বা মা থেকে থেকে শিশুতে সংক্রমণের সম্ভাবনা বাদ দেওয়ার জন্য রেফারেন্স ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়েছিল।
সংস্থাটি আরও জানায়, যদিও পরীক্ষা করে র্যাপিড ও পিসিআর টেস্টে নিপাহ সংক্রমণ পাওয়া যায়নি, কিন্তু অ্যান্টি-নিপাহ আইজিজির একটি উচ্চ টাইটার দেখতে পাওয়া যায়। এভাবেই প্রথমবারের মতো নিশ্চিত হওয়া যায় যে, মা থেকে সন্তানের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসের হিউমোরাল এন্টিবডি পৌঁছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুর হার আনুমানিক ৪০ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হার ৭১ শতাংশ। এছাড়াও নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে গুরুতর স্নায়ুবিক জটিলতা দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং গর্ভবতী নারীদের গর্ভাবস্থার শেষের দিকে এই জটিলতা আরও খারাপ হয়।
মানুষকে খেজুরের রস খাওয়া থেকে সতর্ক করতে, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরিন বলেন, সম্প্রতি আমরা মানুষের মধ্যে আবারও খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করছি এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করার প্রয়াস দেখছি। এটি যে কী ধরণের বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে তা না জেনেই মানুষ খেজুরের কাঁচা রস খাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবাইকে খেজুরের কাঁচা রস পান করতে নিষেধ করছি, রস সংগ্রহে যত সতর্কতাই অবলম্বন করা হয়ে থাকুক এটি অনিরাপদ।’
প্রসঙ্গত, নিপাহ ভাইরাস একটি জুনোটিক ভাইরাস (অর্থাৎ এটি প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়) এবং এটি দূষিত খাদ্য অথবা সরাসরি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে। টেরোপাস জেনাসের ফলখেকো বাদুড় এই ভাইরাসের প্রাকৃতিক ধারক এবং মহামারি সৃষ্টিতে সক্ষম রোগের মধ্যে এটি একটি।
বাংলাদেশে ২০০১ সালে প্রথম এই ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং তখন থেকে এই জনবহুল দেশে প্রায় প্রতি বছরই অনেক মানুষ মারা যায়। আইসিডিডিআর,বির তথ্য অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত, মোট ৩৩১ জন মানুষ নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ২৩৬ জন মৃত্যুবরণ করেছেন।
সারাবাংলা/এসবি/একে