ছুটির দিনে জমজমাট বইমেলা
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২২:৫৮
সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুটের বইমেলা কানায় কানায় পূর্ণ করার জন্য যে পরিমাণ লোকের উপস্থিতি প্রয়োজন, ঠিক সেই পরিমাণ লোকই মেলায় এসেছিলেন শুক্রবার। পূর্ণতা পেয়েছিল অমর একুশে বইমেলার উনচল্লিশতম আসরের দশম দিন।
সকালে শিশু প্রহর, বাচ্চাদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং আবৃত্তি অনুষ্ঠানের বাছাই পর্ব ঘিরে ছুটির দিনে মেলার প্রথম প্রহরটাতে মোটামুটি ছিমছাম একটা পরিবেশ বিরাজ করছিল বইমেলায়। বিকেল ৩টা পর্যন্ত মেলা পরিচালনা কমিটি ও বাংলা একাডেমির লোকজন,স্টল-প্যাভিলিয়নে কর্মরত বিক্রয়কর্মী-কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থার সদস্য ও কর্মকর্তা এবং ইউটিলিটি সেবা দেওয়া ব্যক্তিরা হয়তো ভাবতেই পারেন নি, সব দিক দিয়ে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে পেইনফুল’ মেলায় সন্ধ্যার পর মানুষের এমন ঢল নামবে।
এমনিতেই নির্মাণাধীন মেট্টোরেল স্টেশন চুষে নিয়েছে টিএসসি-দোয়েলচত্বর সড়কের সবটুকু সৌন্দর্য ও নিরাপদে চলার ন্যূনতম সুযোগ। অধিকন্তু সৌন্দর্য বিবর্জিত ভঙ্গিমায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ১১ লাখ বর্গফুট এলাকায় টিনের বেষ্টনী তেরি করে উত্তর-পশ্চিম-পূর্ব পাশ বন্ধ করে দিয়ে অমর একুশে বইমেলাকে রীতিমতো কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছিল- বইমেলায় যেদিক দিয়ে খুশি প্রবেশ ও বের হওয়ার সুযোগ নষ্ট করে দেওয়ায় এবার আর অতীতের মতো জমবে না।
কিন্তু উৎসবপ্রিয় মানুষ বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বইমেলায় হাজির হয়েছে এবং বাধ্য করেছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট সংলগ্ন গেট খুলে দিতে। আর তাতেই অমর একুশে বইমেলার দশম দিনে এসে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জুড়ে ‘ঠাই নেই ঠাই নেই’ অবস্থা।
বিকেল পৌনে ৫ টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ছবির হাট গেটে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, শত শত মানুষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকছে আর বের হচ্ছে। কারণ, বিগত মেলাগুলোতে এই গেট দিয়ে ঢুকেও মেলায় প্রবেশের সুযোগ ছিল। কিন্তু এবার এমনভাবে বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে যে, কেউ যদি এ গেট দিয়ে ঢোকে, তাহলে সে বইমেলায় প্রবেশ করতে পারবে না। সুতরাং বিরক্তিকর হয়রানীর শিকার হয়ে ফের তাকে ছবির হাট সংলগ্ন গেট দিয়ে বেরিয়ে টিএসএস সংলগ্ন গেট দিয়ে মেলায় প্রবেশ করতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে এখানে কোনো নির্দেশনা নেই।
মিরপুর থেকে পরিবার নিয়ে মেলায় আসা আশরাফুর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সবাইকে এদিক দিয়ে ঢুকতে দেখে আমরা ঢুকে পড়লাম। জানতাম না যে, এদিক দিয়ে বইমেলায় প্রবেশ করা যাবে না। এখন আবার টিএসসি পর্ যন্ত হেঁটে গিয়ে মেলায় প্রবেশ করতে হবে। এটা খুবই বিরক্তিকর।
রায়ের বাজার থেকে মেলায় আসা আশিকুল্লাহ আশিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বউ-বাচ্চা নিয়ে তো বারবার মেলায় আসা যাবে না। তাই কষ্ট হলেও ঘুরে গিয়ে মেলায় প্রবেশ করতে হবে। তবে এ ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যবস্থাপনা বাংলা একাডেমির কাছে কাম্য না।’
সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন সংলগ্ন গেটে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে পিঁপড়ার সারির মতো মেলায় ঢুকছে মানুষ। কিন্তু কি এক অজানা কারণে যেন, গত রোববার থেকে এ গেটটি বন্ধ করে রেখেছিল মেলা কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে দায়িত্বরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ এ গেট বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল, আমরা বন্ধ রেখেছিলাম। আজ খুলতে বলেছে, খুলে দিয়েছি।’
সন্ধ্যা ৭ টায় মেলা ঘুরে দেখা যায় পুরো মেলায় শুধু মানুষ আর মানুষ। কোথাও এক ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা নেই। সব বয়সী, সব শ্রেণির মানুষ স্টল-প্যাভিলিয়নে ভিড় জমিয়েছে। কেউ কেউ সেলফি তুলছে, কেউ কেউ প্রিয়জনকে নিয়ে জলাধারের পাশে বসে আছে, কেউ কেউ বই কেনা শেষে ঘরে ফেরার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে কেউ কেউ আবার প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে মেলায় প্রবেশ করছে।
মেলাল বঙ্গমাতা চত্বরে দাঁড়িয়ে কথা হয় ধানমন্ডি থেকে আসা খন্দর লুৎফর রহমানের সঙ্গে। হাতভরা বই নিয়ে লুৎফর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সব আয়োজনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে একখানে সমবেত করা। সেই দিক দিয়ে বলতে হয়, আজকের বইমেলা খুবই উপভোগ্য। আর অস্বস্তির জায়গাটা হচ্ছে ঢোকা ও বের হওয়ার পথের দুর্ভোগীকরণ। টিএসসি সংগলগ্ন গেট দিয়ে মানুষ বেশি প্রবেশ করে। নির্মাণ সামগ্রী, যানবাহন, রিকশা, দোকান-পাঠ— সব কিছু দিয়ে জায়গাটাকে দোযখ বানিয়ে রেখেছে। কার কাছে প্রতিকার চাইব। যারা বিবেকদ্বারা ও বোধ-বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয়, তাদের কাছে কিছু চাইতে হয় না। আর এগুলো নেই, তাদের কাছে চেয়ে কোনো লাভ নেই।’
লালবাগ থেকে মেয়ে নিয়ে মেলায় আসা মাকসুদা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বইমেলার ভেতরটা সুন্দর। কিন্তু বাইরে এবং আশপাশের অবস্থা খুবই করুণ। বাংলা একাডেমির উচিত এগুলোর দিকে নজর দেওয়া। এত বড় আয়োজনে এমন গা’ছাড়া ভাব ঠিক না।’
মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান
অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮ টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। এতে ক-শাখায় ১৯৫, খ-শাখায় ১৮৩ এবং গ-শাখায় ৬৮ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেন শিল্পী হাশেম খান।
সকাল সাড়ে ৯ টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তেন শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বাছাই পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এতে দুই শতাধিক প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন। বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন কাজী মদিনা, আন্জুমান আরা এবং নূরুল হাসনাত জিলান।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ’ এবং ‘জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: এস এম সুলতান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মলয় বালা এবং সৈয়দ নিজার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সুশান্তকুমার অধিকারী, ইমাম হোসেন সুমন, নাসির আলী মামুন এবং নীরু শামসুন্নাহার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মুনতাসীর মামুন।
প্রাবন্ধিকদ্বয় বলেন, ‘বাংলাদেশের ছাপচিত্রের পথিকৃৎ এবং উপমহাদেশের স্বানামধন্য ছাপচিত্রী সফিউদ্দীন আহমেদ এদেশের শিল্প আন্দোলনের সূতিকাগার ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টে’র প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। তিনি সফল তেলরং শিল্পী, ছাপচিত্রী এবং একজন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর শিক্ষক। জীবন ও কর্মে তার সাধনার ধরন, নিভৃতচারী স্বভাব, বিলাসবর্জিত জীবনযাপন, সততা, শুদ্ধাচার, সংগীতানুরাগ, মুক্তদৃষ্টি, ধ্যান, শিল্পসাধনা ও ব্যক্তিত্ব তার চরিত্রে জুগিয়েছে অভিনতুন মাত্রা। অপরদিকে এস এম সুলতান শুধু চিত্রশিল্পীই ছিলেন না, তার স্বতন্ত্র দর্শন, রাজনীতি, সমাজ নন্দনভাবনা ছিল, যা একই সাথে দেশজ ও সময়ের চেয়ে অগ্রগামী। সুলতান আমাদের চিন্তা ও শিল্পচর্চায় ঔপনিবেশিকতার ছাপগুলি খুঁজে বের করেছেন যা বি-উনিবেশায়নের প্রাথমিক শর্ত।
সভাপতির বক্তব্যে মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ এবং এস এম সুলতান আমাদের শিল্পকলার জগতে উজ্জ্বল দুই নক্ষত্র। সফিউদ্দীন আহমেদ প্রাতিষ্ঠানিকতার মধ্যে থেকে নিখুঁত কলাকৌশলের মাধ্যমে শিল্পচর্চা করে গেছেন। অন্যদিকে এস. এম. সুলতান শিল্পচর্চার দিক থেকে ছিলেন সাধারণ মানুষের কাছাকাছি, যে কারণে তার ছবির ভেতর আমরা নিজেদের খুঁজে পাই।’
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন মৌলি আজাদ, সাগরিকা নাসরীন, সাহাদাত পারভেজ এবং হুমায়ূন কবীর ঢালী।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন বায়তুল্লাহ কাদেরী, সঞ্জীব পুরোহিত, ফারহানা রহমান এবং রুহ রুহেল। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ডালিয়া আহমেদ, নুরুজ্জামান, মাসুদ রানা, মাহমুদুল হাকিম তানভীর। এছাড়াও ছিল জিনিয়া জ্যোৎন্সার পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘জিনিয়া নত্যৃকলা একাডেমি’ মনোমি তানজানার পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘নিক্কন পারফরমিং আর্ট সেন্টার’, মো. জাকির হোসেনের পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘শান্তি ভাবদর্শন চর্যাকেন্দ্র’, পারভীন আক্তার আঁখির পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘আনসার ডান্স একাডেমি’- এর নৃত্য পরিবেশনা। আবৃত্তি পরিবেশনা করেন ‘বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ’ এবং ‘ত্রিলোক বাচিক পাঠশালা’-এর শিল্পীবৃন্দ।
আগামীকাল অমর একুশে বইমেলার ১১তম দিন। মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১টা থেকে বেলা ১ টা পর্যন্ত মেলায় শিশুপ্রহর চলবে। সকাল ১০টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তেন শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বাছাই পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ: আশরাফ সিদ্দিকী’ এবং ‘স্মরণ সাঈদ আহমদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইয়াসমিন আরা সাথী এবং মাহফুজা হিলালী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন উদয়শংকর বিশ্বাস, শামস্ আল দীন, রীপা রায় এবং আব্দুল হালিম প্রামাণিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন খুরশীদা বেগম।
সারাবাংলা/এজেড/একে