দীর্ঘমেয়াদী গৃহ ঋণের সুদ হার বেড়ে গেলে কী কী করতে পারেন
৭ এপ্রিল ২০২৩ ২০:১২
ঢাকা: আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় গ্রাহকরা গৃহ ঋণ নেওয়া শুরু করেন ৪০-৪৫ বছর বয়সের পরে। বিশ্বব্যাপী এখন প্রায় সব দেশেই ঋণের সুদের হার বেড়ে চলছে। যদিও সেসব দেশে গত কয়েক বছরে এই সুদ হার বাড়েনি। কিন্তু আমাদের দেশে কয়েক বছর পর পরই ঋণের সুদের হার ওঠানামা করে। যদিও কোভিড ক্রান্তিকালীন সময়ে আমরা কিছুটা ব্যতিক্রম দেখেছি।
গৃহঋণের সুদের হার আমাদের দেশে আবারও বাড়ার পথে রয়েছে। ফলে দেখা যাবে যে, অনেক গ্রাহকেরই ঋণ পরিশোধের সময়সীমা তাদের অবসরের সময়সীমাকে অতিক্রান্ত করে যাবে। সাধারণত ঋণের সুদের হার যখন বৃদ্ধি পায় তখন হয় কিস্তি বা মেয়াদ বৃদ্ধি পায়। যে সমস্ত গ্রাহক কিস্তির পেছনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে পারেন না, তাদের ঋণের মেয়াদ সাধারণ সময় থেকে বেড়ে যায়। ফলে ঋণগ্রহীতারা সুদের হার বৃদ্ধির কারণে তীব্র চাপের মধ্যে পড়ে যায়।
একটি দীর্ঘ ঋণ মেয়াদের প্রধান অসুবিধাগুলোর মধ্যে একটি হলো যে, এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও সুদ পরিশোধ করতে হতে পারে। কারণ ঋণের মেয়াদ যত দীর্ঘ হবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ততো বেশি সুদ জমা হবে। তাছাড়া মেয়াদপূর্তির আগে যদি বেশ কয়েকবার সুদের হার বেড়ে যায় তখন গ্রাহককে অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। কারো যদি দীর্ঘমেয়াদী ঋণ থাকে, তাহলে এটি অন্যান্য আর্থিক সিদ্ধান্ত এবং বিনিয়োগ করার ক্ষমতাকে সীমিত করতে পারে এবং এমনকি অবসর গ্রহণের পর অবসরকালীন সুবিধাদি জলাঞ্জলি দিতে হতে পারে।
একটি দীর্ঘ ঋণের মেয়াদ পরিচালনা করা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে যদি আপনার অবসরের পরেও ঋণের কিস্তি চালিয়ে নিতে হয়। সেক্ষেত্রে আপনি আগে থেকেই আপনার সকল আয়, খরচ, সঞ্চয় এবং ঋণ পর্যালোচনা শুরু করুন। দীর্ঘ ঋণের মেয়াদ পরিচালনা করতে আপনি নিম্নোক্ত কয়েকটি ব্যাপার খেয়াল রাখতে পারেন:
১) আপনার আর্থিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করুন: আপনার ঋণ পরিশোধের জন্য প্রতি মাসে যে পরিমাণ কিস্তি ব্যয় করতে হতে পারে তার থেকে অতিরিক্ত কোনো অর্থ সংসারের অন্যান্য খরচ মিটিয়ে আপনার হাতে থাকে কিনা? যদি থাকে তার অর্থ হচ্ছে ভবিষ্যতে সুদের হার বেড়ে গেলে আপনি কিছুটা বাড়তি কিস্তি দিতে সক্ষম হবেন।
২) ঋণদাতাদের সঙ্গে নিয়মিত দেন দরবার করুন: যদি আপনার ঋণের কিস্তি নিয়মিত থাকে তাহলে ঋণদাতার সঙ্গে নিয়মিত সুদের হার কমানোর ব্যাপারে দেন দরবার চালিয়ে যেতে পারেন। তাহলে আপনি একটা সময় ঋণের কিস্তির পরিমাণ এবং মেয়াদ কিছুটা কমাতে পারবেন।
৩) ঋণের আংশিক অর্থ মেয়াদ পূর্তির আগে প্রদান: আপনার হাতে যদি বাড়তি অর্থ থাকে, যা থেকে আপনি ঋণের মেয়াদ পূর্তির পূর্বে কিছু অংশ প্রদান করতে পারবেন তাহলে তা পরিশোধ করে ফেলুন। ব্যাংকের পরিভাষায় এটিকে ‘প্রি-পেমেন্ট’ বলে। সাধারণত ব্যাংকগুলো পুরো ঋণ উত্তোলন করার ৬ মাস পর থেকে, অর্থাৎ ৬টি কিস্তি প্রদান করার পরেই প্রি-পেমেন্ট করার সুবিধা প্রদান করে থাকে। তবে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রি-পেমেন্টের ক্ষেত্রে আপনার ঋণের অবশিষ্টাংশের ওপর ২ শতাংশ অতিরিক্ত চার্জ আদায় করে থাকে, যা আপনি গ্রাহক-ব্যাংকের সম্পর্ক উন্নয়নের উপর জোর দিয়ে কমাতে আবেদন করতে পারেন।
প্রি-পেমেন্ট করার অর্থ হলো আপনি আপনার নিজেকে ঋণের সমস্ত বকেয়া পরিশোধ থেকে কিছুটা অংশ বাঁচাতে পারছেন। অর্থাৎ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনার ঋণের বোঝা এবং ঋণের মোট খরচ কমাতে সাহায্য করতে পারবে।
প্রি-পেমেন্ট করার কিছু সুবিধা রয়েছে-
ক) এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনার প্রদত্ত সুদের মোট পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। এই কারণে যে সুদ সাধারণত ঋণের বকেয়া মূল অবশিষ্টাংশ/ব্যালেন্সের উপর গণনা করা হয়। তাই মূল পরিমাণ হ্রাস করার পাশাপাশি আপনি আরোপিত সুদের পরিমাণও কমাতে পারেন।
খ) আংশিক অর্থ প্রদান করা আপনাকে দ্রুত ঋণ পরিশোধ করতে সাহায্য করতে পারে। বকেয়া মূল পরিমাণ হ্রাস করার মাধ্যমে, আপনি আপনার করা মোট অর্থ প্রদানের সংখ্যা হ্রাস করতে পারেন, যা ঋণের মেয়াদকে ছোট করতে পারে এবং আপনাকে দ্রুত ঋণ মুক্ত হতে সাহায্য করতে পারে।
আপনি যদি প্রতি বছর ঋণের অবশিষ্টাংশের ৫ শতাংশ পরিশোধ করেন, তাহলে আপনি আপনার ২০ বছরের ঋণ ১২ বছরে পরিশোধ করতে পারবেন। প্রতি বছর একটি অতিরিক্ত কিস্তি প্রি-পেমেন্ট করলে আপনার ঋণ মাত্র ১৭ বছরে শেষ হয়ে যেতে পারে। আপনি যদি প্রতি বছর আপনার কিস্তি ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেন, তাহলে আপনি ১৩ বছরেরও কম সময়ে আপনার ঋণ শেষ করতে পারবেন।
৪) সুদের হার কমে গেলে ঋণ পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা গ্রহণ করুন: আপনার সুদের হার যখন কমে যাবে তখন গ্রাহক-ব্যাংক সম্পর্ক উন্নয়নের ধারায় পুনঃঅর্থায়নের সুবিধার আওতায় বর্তমান ঋণ যেটিতে বেশি সুদ দিতে হচ্ছে তা একটি নতুন ঋণের সঙ্গে প্রতিস্থাপন করুন। তবে তার পূর্বশর্ত হচ্ছে আপনার আগের সকল কিস্তি যথাযথভাবে পরিশোধ করা থাকতে হবে।
৫) আপনার ঋণ একত্রিত করুন: যদি একাধিক ঋণ থাকে, তাহলে আপনাকে অবশ্যই আপনার অন্য ঋণ বন্ধ করতে হবে এবং একাধিক ঋণের জন্য আলাদাভাবে কিস্তি প্রদান করার পরিবর্তে শুধুমাত্র একটি বড় ঋণ প্রদানের দিকে মনোনিবেশ করা ভালো হবে। গৃহঋণ দিয়ে অন্যান্য ব্যক্তিগত ঋণ পরিশোধ করতে চাইলে আমাদের দেশে ব্যাংকের চাইতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি সুবিধা দিয়ে থাকে।
৬) অতিরিক্ত আয়ের উৎস সন্ধান করুন: আপনি আয় বাড়ানোর জন্য একটি খণ্ডকালীন চাকরি বা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করার কথা বিবেচনা করতে পারেন। যদি শিক্ষকতার মতো কোনো পেশায় নিয়োজিত হয়ে থাকেন, তাহলে মূল চাকরির সময় অন্যান্য চাকরির মতো দীর্ঘ না হয়ে থাকার কারণে আপনি এই পদক্ষেপ নিতে পারেন। অন্যথায় ওভারটাইম, পারফর্মেন্স বোনাস বা ইনক্রিমেন্ট লাভ করার জন্য বাড়তি পরিশ্রম করার অভ্যাস করুন।
৭) আপনার ব্যয়কে অগ্রাধিকার দিন: আপনার ব্যয়ের তালিকা সবসময় সংরক্ষণ করুন। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে মেয়াদ পূর্তির আগে দ্রুত ঋণ পরিশোধে মনোযোগী হন।
৮) সন্তানদের সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে তাগিদ দিন: ভারতের মতো দেশে ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী যারা রয়েছেন তাদের মাত্র ১৭ শতাংশ ইনস্যুরেন্স পলিসি গ্রহণ করেছেন আর অন্যদিকে ৫৫ শতাংশ ইন্সুরেন্সের নামই শোনেননি! তাহলে আমাদের দেশে এই হার আরও কম হতে পারে। তাই আপনাদের সন্তানদের স্কুলে থাকা অবস্থায় সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলুন, তাতে আপনার অবর্তমানে ঋণ পরিশোধে সহায়ক হতে পারে।
৯) আপনার অবসরকালীন সঞ্চয় ব্যবহারে সতর্ক হন: আপনি যদি মনে করেন অবসরকালীন ভাতা ও সুবিধাদি দিয়ে আপনি আপনার পুরো ঋণ পরিশোধ করে ফেলবেন, তাহলে সেটা হবে মস্ত বড় একটি ভুল ধারণা। সন্তানদের উপর নির্ভর না হয়ে অবসরকালীন সুবিধার একটি বড় অংশ নিজের খরচ চালানোর জন্য নিজের কাছে বা ব্যাংকে জমা রাখুন। উপরের ৮টি অভ্যাস যথাযথভাবে অনুসরণ করতে পারলে অবসরকালীন সুবিধাদি দিয়ে ঋণ পরিশোধে ব্যয় নাও করতে হতে পারে।
১০) কিছু সম্পদ বিক্রি করুন: আপনার ঋণ পরিশোধ করতে জমি, শেয়ার/ডিবেঞ্চার/বন্ড, এফডিআর, ইন্সুরেন্স, দ্বিতীয় কোনো বাড়ি বা গাড়ির মতো সম্পদ বিক্রি করার কথা বিবেচনা করুন, যা থেকে আপনার বাড়তি কোন অর্থ আয় হচ্ছে না, ব্যয় সংকুচিত করা যাচ্ছে না অথবা ওই সমস্ত সম্পদের আয় ঋণ পরিশোধের ব্যয় থেকে যদি কম হয়ে থাকে। এটি আপনার আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে সহজ করে তুলতে পারে।
সারাবাংলা/আইই