Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এক বছরে পদ্মা সেতু: শুধু পথেরই নয়, দূরত্ব কমেছে শহর-গ্রামের

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৫ জুন ২০২৩ ০৮:৩৬

ফাইল ছবি

ঢাকা: দেশের দক্ষিণের জেলা বরগুনার সঙ্গে রাজধানীর ঢাকার দূরত্ব ৩২৭ কিলোমিটার। একটা সময় ছিলো ঢাকা থেকে বাসে করে বরগুনা পৌঁছাতে পুরোদিন লেগে যেতো। আর ফেরি খারাপ হলে চব্বিশ ঘণ্টা পথে কেটে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। এই দুর্ভোগের কারণে শুধু বরগুনাই নয় বরিশাল শহর থেকে দূরের জেলাগুলোর মানুষ কোনো উৎসব কিংবা জরুরি প্রয়োজনেই কেবল যাতায়াত করতেন রাজধানীতে। কিন্ত পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দশ কিংবা বারো ঘণ্টার দূরত্ব পাঁচ ঘণ্টায় নেমেছে। যে কারণে শুধু বরিশালই নয় দক্ষিণের ২১ জেলার মানুষের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব যেমন কমেছে, তেমনি বেড়েছে যাতায়াত। বদলে যাচ্ছে অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটও। ওই সব অঞ্চলের মানুষদের বক্তব্য, পদ্মা সেতু তাদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। পদ্মাসেতুর কারণে জাজিরা, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরের অজপাড়াগাঁওয়েও নির্মিত হচ্ছে বাণিজ্যিক ভবন। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় মানুষের আয় বেড়েছে।

রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনে একমাত্র বাধা ছিলো পদ্মা নদী। দীর্ঘ সময় কেটে যেতো এই নদী পারাপারে। আবার ফেরি নষ্ট হলে পারাপারে সময় কখনও দ্বিগুণ লেগে যেত। মানুষ কম সময়ে যাতায়াতের জন্য লঞ্চ কিংবা ঝুঁকি নিয়ে স্পিড বোটে করে নদী পার হতো। কখনো কখনো ঘটে যেতো বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে অর্থনৈতিক গতি চাঙ্গার উদ্দেশ্য নিয়েই ২০০৭ সালে পদ্মায় সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে সেই পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয় ২০২২ সালে। ওই বছরের ২৫ জুন এক জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় বহু প্রতিক্ষীত পদ্মা সেতু। দেশে বিদেশি কূটনীতিক, রাজনীতিক, সুশিল সমাজের ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ২৫ জুন উদ্বোধন করা হলেও তার এক দিন পর অর্থাৎ ২৬ জুন থেকে সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু করা হয়। আর এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীতে যাতায়াতের পথ সহজ হয়।

পদ্মাসেতু চালুর পর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী গ্রামের মানুষগুলো যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। কেউ ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে কিংবা অফিস শেষ করে বাসেই রওয়ানা দেন শিকড়ের কাছে। গ্রাম থেকে যারা একরকম বিচ্ছিন্ন ছিলেন, সেই শহরে মানুষদের যাতায়াত বেড়েছে গ্রামে। বলা যায়, পরিবার পরিজন রেখে ইট-পাথরে গড়া রাজধানী ঢাকায় জীবনযাপন যারা করছেন, তাদের জন্য প্রশান্তি বয়ে এনেছে পদ্মা সেতু।

বরিশালের নাগরিক মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তিনি সারাবাংলাকে জানান, বরিশালের কাশিপুর এলাকায় তার পৈত্রিক বাড়ি। চাকরির সুবাদে গত ২০ বছর রাজধানী ঢাকায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে নিরাপদ ও শান্তির যানবাহন লঞ্চ। কিন্তু যখন জরুরি দরকার হয়, তখন লঞ্চে যাতায়াত কঠিন হয়ে যায়। কারণ লঞ্চ রাতে চলাচল করে। পদ্মা সেতু হওয়াতে বাসে করে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি লাগে না। এখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই মাকে দেখে আসতে পারি।’

একই কথা বলেছেন ঝালকাঠির অনিমেষ দাস। তিনি বলেন, ‘আমরা ছোট থেকে লঞ্চে যাতায়াত করে অভ্যস্ত। তবে যখন শুরুতে পদ্মাসেতু পেরিয়ে বাড়ি এলাম, তারপর এক রকম মজা পেয়ে যাচ্ছি। সকালে বাসে উঠলে দুপুরে ভাত খেতে পারি বাড়িতে। এটা আগে কখনোই সম্ভব হতো না।‘

পদ্মাসেতুর কারণে এর আসেপাশের এলাকা যেমন জাজিরা, শরিয়তপুর, মাদারীপুর ফরিদপুরের অজপাড়াগাঁওয়েও নির্মিত হচ্ছে বাণিজ্যিক ভবন। এই সেতুকে কেন্দ্র করে পদ্মার দুই পাড়েই ছোট ছোট ব্যবসা গড়ে উঠেছে। যদিও নৌপথের ব্যবসায় ভাটা নেমেছে। তবে অনেকেই ব্যবসা বদলে ফেলেছেন। আবার কেউ কেউ ধরে রেখেছেন পর্যটকদের জন্য।

পদ্মা নদীতে স্পিড বোটের ব্যবসা করতেন মোখলেসুর রহমান। তিনি সারাবাংলাকে জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর মানুষ নৌপথে যাতায়াত করা কমিয়ে দিয়েছে। একদম শূন্যে নেমেছে বলা চলে। পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকার পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিলো। এখন স্পিড বোট বিক্রি করে সেই সঙ্গে লোন নিয়ে গাড়ি কিনে তা দিয়ে সেতু পারাপার করেন।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে থানা, ডরমেটরি, হোটেল, রেস্তরা, মার্কেট গড়ে উঠেছে। চালু হচ্ছে শিল্প কারখানাও। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটাকেই বলে অর্থনৈতিক পরিবর্তন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘একটা অবকাঠামো গোটা এরিয়া বদলে দিতে পারে। যদি সেটা পরিকল্পনামাফিক হয়। পদ্মা সেতু এমনই এক স্থাপনা যা বহুমুখী উন্নয়ন ঘটিয়েছে। শহর থেকে শহর কিংবা গ্রামের দূরত্ব কমিয়েছে, সম্পর্কের দূরত্বও কমিয়েছে, অর্থনীতিতে পরিবর্তন এনেছে।’

সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, গত এক বছরে পদ্মাসেতু দিয়ে আয় হয়েছে ৭০০ কোটি টাকার বেশী। যদিও এর লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে দশ মাসে আয় হয়েছে ৬৭৪ কোটি টাকা। এই সময়ের মধ্যে সেতু দিয়ে ৪৭ লাখের বেশি যানবাহন পারাপার করেছে। সেই হিসাবে গড়ে প্রতিদিন পদ্মা সেতু থেকে প্রায় ২ কোটি ১৮ লাখ টাকা টোল আদায় করা হচ্ছে। আর গড়ে প্রতিদিন সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপার হয়েছে ১৬ হাজার ২২৩ টি।

এদিকে প্রকল্পের খরচ আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (২২ জুন) সরকারের অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় ফের ১১০০ কোটি টাকা বাড়ানোর একটি প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়।

দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ এই পদ্মাসেতু নির্মাণে ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হয়েছে। পদ্মাসেতু প্রকল্পের মূল ব্যয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকায়। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের করা সম্ভাব্যতা জরিপে বলা হয়েছে, সেতুটি নির্মিত হলে দেশের জিডিপি এক দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। সেতু থেকে হওয়া আয় এবং সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে অর্থনীতিতে আমুল পরিবর্তন হবে। আর সেতু থেকে যানবাহনের কাছ থেকে আদায় করা টোলের মাধ্যমে আসা অর্থ দিয়ে সেতুর নির্মাণ ব্যয় এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হবে।

সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় বলা হয়েছিলো দিনে গাড়ি যাতায়াতের হিসাব অনুযায়ী ২৫ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে টোলের আয় থেকে নির্মাণ ব্যয় তুলে আনা সম্ভব হবে।

সারাবাংলা/জেআর/এমও

পদ্মা সেতু শহর-গ্রাম


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর