Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পদ্মা সেতু চালুর এক বছরে বদলে গেছে মোংলা বন্দর

ডিস্ট্রিক্ট করসেপন্ডেন্ট
২৬ জুন ২০২৩ ০৯:১৭

বাগেরহাট: পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এক বছরের মধ্যেই দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলায় আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের মহাকর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। সেতুর কল্যাণে রাজধানী ঢাকা থেকে সবচেয়ে কাছের বন্দর হয়ে গেছে মোংলা বন্দর। তাই এই বন্দর দিয়ে গার্মেন্টস শিল্পের বিভিন্ন পণ্য যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকায়। বেড়েছে গাড়ি আমদানি। বন্দরের আশেপাশে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শিল্প কারখানা।

প্রতিদিনই চাপ বাড়ছে মোংলা বন্দরের। চাপ সামলাতে সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর ব্যবহারকারীদের জন্য ভ্যাসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের উন্নয়ন, সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন, কন্টেইনার ইয়ার্ড সংস্কার, বন্দরের পশুর চ্যানেলের ইনার বারে ২৩ কিলোমিটার ড্রেজিং ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নসহ নানা ধরনের উন্নয়ন কাজ চলছে।

বিজ্ঞাপন

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ সচিব মো. মাকরুজ্জামান জানান, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এক বছরের মধ্যেই দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলায় আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে গতি এসেছে। এখন রাজধানীর সব থেকে কাছের বন্দর হওয়ায় মোংলা বন্দর হয়ে পোশাক শিল্পের পণ্য যাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এছাড়া এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে।

তিনি জানান, মোংলা বন্দর দিয়ে গত বছরের ২৬ জুন প্রথম গার্মেন্টস পণ্য রফতানি হয় ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডে। এরপর ৭ জুলাই দ্বিতীয় চালান, চলতি বছরের ৫ মে তৃতীয় চালান, ৬ জুন চতুর্থ চালান গার্মেন্টস পণ্য রফতানি হয়। এছাড়া ডেনমার্ক ও ব্রিটেনেও গার্মেন্টস পণ্য গেছে পদ্মা সেতু চালুর পর। পাশাপাশি ভারত, নেপাল ও ভুটানকে বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে মোংলা বন্দর।

বিজ্ঞাপন

উল্লেখ্য, গত বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরদিন ২৬ জুন সাধারণ যান চলাচলের জন্য সেতু খোলে দেওয়া হয়।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক জানান, পদ্মা সেতু চালুর পর মোংলা বন্দরের আধুনিকায়নে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। বন্দরের ড্রেজিং ব্যবস্থা উন্নয়নে ৭৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে বন্দরের পশুর চ্যানেলের ইনার বারে জয়মনি ঘোল থেকে বন্দর জেটি পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার ড্রেজিং করা হচ্ছে। চ্যানেলটির ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হলে ৯ দশমিক ৫০ মিটার থেকে ১০ মিটার গভীরতার কন্টেইনারবাহী জাহাজ সরাসরি জেটিতে ঢুকতে পারবে।

মো. জহিরুল হক জানান, বন্দরের কন্টেইনার রাখার স্থানবৃদ্ধির জন্য প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে কন্টেইনার ইয়ার্ড, যার ধারণক্ষমতা হবে এক হাজার ৫০টি কন্টেইনার। এছাড়া মোংলা বন্দরে অবস্থান করা বিদেশি জাহাজে এবং বন্দর এলাকার শিল্প অঞ্চলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। বন্দর ব্যবহারকারীদের জন্য জরুরি বার্তা সেবা কার্যক্রমের উন্নয়ন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বন্দর চ্যানেলে প্রবেশ করা প্রতিটি জাহাজ তদারকির পাশাপাশি গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা সহজ হবে। পাশাপাশি ৪৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে মোংলা বন্দরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে বন্দরে চলাচলকারী বিভিন্ন বাল্ক, কন্টেইনার, ট্যাংকার ও অন্যান্য জলযান থেকে নিঃসৃত তেল ও পেট্রোলিয়াম বর্জ্যসহ অন্যান্য আবর্জনা সংগ্রহ করা সহজ হবে। একই সঙ্গে পশুর চ্যানেল ও বন্দরের আশপাশের নদ-নদীতে বিভিন্ন জাহাজ থেকে নিঃসৃত তেল অপসারণ সহজ হবে।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী জানান, পদ্মা সেতু চালুর পর মোংলা বন্দরের উপর চাপ বেড়েছে, এই চাপ সামাল দিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বন্দর উন্নয়নে ছয় হাজার ২৫৬ কোটি টাকার ১০টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের আওতায় ১২টি কম্পোনেন্টের মধ্যে রয়েছে, বন্দর জেটিতে ১ ও ২ নং কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ইয়ার্ড নির্মাণ, কন্টেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণ, ইয়ার্ড শেড, নিরাপত্তা দেয়াল অটোমেশন ও অন্যান্য অবকাঠামোসহ বন্দরের সংরক্ষিত এলাকা সম্প্রসারণ, সার্ভিস ভেসেল জেটি শেড ও অফিস নির্মাণ, বন্দর প্রশাসনিক ভবন সম্প্রসারণ, এমপিএ টাওয়ার, পোর্ট রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্স কমিউনিটি সুবিধাদি নির্মাণ, ইকুইপমেন্ট ইয়ার্ড, ইকুইপমেন্ট শেড ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ এমটি পুল নির্মাণ, সিগনাল রেড ক্রসিং ও ওভারপাস নির্মাণ, বিনোদন ব্যবস্থাসহ বাঁধ নির্মাণ। এছাড়া পাঁচটি হারবার ক্রাফট কেনা হচ্ছে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সময় সাশ্রয় ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা এখন মোংলা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বর্তমানে মোংলা বন্দরের নিজস্ব জমিতে ১১টি এলপিজি কারখানা, পাঁচটি সিমেন্ট কারখানাসহ আরও ১০টি শিল্পকারখানা রয়েছে। এছাড়া বন্দর এলাকায় ২৫৮ একর জমিতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেপজা) রয়েছে। এসব শিল্প কারখানার কাঁচামাল মোংলা বন্দরের মাধ্যমে আসছে। ফলে বাণিজ্যিক স্বার্থেই বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি সরকারের কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। পদ্মা সেতু ও খুলনা-মোংলা রেলসেতু এবং রামপাল মৈত্রী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়ায় মোংলা বন্দরকেন্দ্রিক দেশের শিল্প-বাণিজ্যের অমিত সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত সূচিত হয়েছে। ইতোমধ্যে এই বন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়েছে মোংলা বন্দরের প্রতি। এতে কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে গোটা বন্দর এলাকা।

মোংলা বন্দর উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ও খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, বিগত জোট সরকারের আমলে মোংলা মৃত বন্দরে পরিণত হয়েছিল। সেখান থেকে বর্তমান সরকার এ বন্দরকে টেনে তুলেছে। বন্দর ঘিরে এখন শুধু উন্নয়নের ছোঁয়া। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন মোংলা বন্দরে গতি এসেছে। এখন প্রতিদিনই ৪০ থেকে ৫০টি জাহাজ এ বন্দরে আসছে।

তিনি বলেন, মোংলা বন্দরকে ঘিরে বর্তমান সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে। পদ্মা সেতু থেকে মোংলা পর্যন্ত ছয় লেন বিশিষ্ট সড়ক ও মোংলা বন্দরের সঙ্গে এবছরই রেল যোগাযোগ স্থাপন হচ্ছে। মোংলা ইপিজেড সম্প্রসারণ, স্পেশাল ইকোনমিক জোন স্থাপন, রূপসা নদী ও মোংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের নাব্যতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী এইচ এম দুলাল বলেন, পদ্মা সেতু এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ঢাকা থেকে মোংলা বন্দরের দূরত্ব এখন ১৭০ কিলোমিটার। যেখানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ২৬০ কিলোমিটার। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সময় এবং অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে। এছাড়া মোংলা বন্দরে জাহাজ হ্যান্ডলিং দ্রুত ও নিরাপদ হওয়ায় বিদেশি ব্যবসায়ীরাও এ বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন। এতে বন্দরটি চাপে পড়েছে।

সারাবাংলা/আইই

পদ্মা সেতু মোংলা বন্দর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর