বারে আইনজীবীদের দ্বন্দ্বের সমাধান কোন পথে?
২ জুলাই ২০২৩ ০৮:৪৭
ঢাকা: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি দেশের অত্যন্ত মর্যাদাশীল একটি পেশাদার সংগঠন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, প্রকাশ পাকরাশি, সৈয়দ মোদারেস আলী এবং সবিতা রঞ্জন পালের (এস আর পাল) মতো বরেণ্য আইনজীবীদের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট বার প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরবর্তীতে তফাজ্জল আলী (টি আলী), এম এইচ খন্দকার, আতাউর রহমান খান, মির্জা গোলাম হাফিজ, টিএইচ খান, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমাদ, সিরাজুল হক, সামসুল হক চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, আবদুল বাসেত মজুমদার, মাহবুবে আলম, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতো বিখ্যাত আইনজ্ঞরা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। এসব নেতারা সুপ্রিম কোর্ট বারকে পেশাদারিত্ব ও মর্যাদায় নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (সুপ্রিম কোর্ট বার) গত নির্বাচনকে (২০২৩-২০২৪ মেয়াদে) কেন্দ্র করে দু’পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হাতিহাতি, মারামারি, ভাঙচুর, মামলা, গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা দেশের গণ্ডী পেরিয়ে বহু বিদেশি গণমাধ্যমেও সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। ওই নির্বাচনের পর থেকে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে আইনজীবীদের বিবদমান সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ, মিছিল, মানববন্ধন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নানা সময়ে বিভিন্ন দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা মিছিল, সমাবেশ, শোডাউন করে; দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে দ্বন্দ্ব, সংঘাতে জড়ায়। সুপ্রিম কোর্ট বারেও এখন একই চিত্র চোখে পড়ে। যেখানে দু’পক্ষের আইনজীবীদের নানারকমের মহড়া চলে। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে বারের মর্যাদা। হ্রাস পাচ্ছে আইনজীবীদের সম্মান। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বারের পেশাদার আইনজীবীরা।
অন্যদিকে, এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের বাইরেও তৈরি হয়েছে মোর্চা, ফ্রন্ট নামে একাধিক সংগঠন। আর নানা বলয়, বিভাজন ও অপ্রীতিকর আচরণের কারণে আইনজীবীদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসে যেমন চিড় ধরছে; তেমনি তৈরি হচ্ছে নেতিবাচক মনোভাব।
কেন, কীভাবে এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? হামলা, ভাঙচুর, মামলার বিষয়ে বিবদমান পক্ষগুলোই বা কী বলছে এবং এসব সমস্যার সমাধান কোন পথে? সিনিয়র আইনজীবীদের পরামর্শই বা কী?
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলছেন, ‘একসময় আইনজীবীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল অপরিসীম। এবং তখন ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর কল্যাণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার মতো উদার মানসিকতা পোষণ করতেন পেশাদার আইনজীবীরা। কিন্তু বর্তমানে ব্যক্তি স্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতেই ব্যস্ত থাকে বেশিরভাগ আইনজীবী। আর বৃহত্তর কল্যাণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে অনীহা, বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান না করা এবং পরমত সহিষ্ণুতার অভাবে বারে বিশৃঙ্খলা, দ্বন্দ্ব, সংঘাতের সৃষ্টি হচ্ছে।‘
বার কাউন্সিলের কন্ডাক্ট অব ইথিকস অব লইয়্যারে (Conduct of Ethics of Lawyers) আইনজীবীদের নৈতিকতা, পেশাগত আচরণ এবং শিষ্টাচার সম্পর্কে বলা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রত্যেক অ্যাডভোকেটের কর্তব্য হলো- সর্বাবস্থায় তার পেশার মর্যাদা এবং উচ্চ অবস্থান, সেই সঙ্গে তার সদস্য হিসাবে তার নিজের মর্যাদা এবং উচ্চ অবস্থানকে সমুন্নত রাখতে হবে।
গত সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনের পর আইনজীবীরা সর্বাবস্থায় তাদের পেশার মর্যাদা এবং উচ্চ অবস্থান, সেই সঙ্গে বারের সদস্য হিসাবে তাদের মর্যাদা এবং উচ্চ অবস্থানকে কতটুকু সমুন্নত রাখতে পেরেছে সে বিষয়ে এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে।
পেশাদার আইনজীবীদের হিংসাত্মক ও অসহিষ্ণু আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয় উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন কেন্দ্রীক ঘটনায় জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা দুপক্ষের আইনজীবীদের নিয়ে বসে এই সংকট সমাধানের উদ্যোগ নিতে পারেন। এছাড়া আমি মনে করি, সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবীদের বিবদমান দ্বন্দ্ব, সংকট ও সমস্যা সমাধানে প্রধান বিচারপতিও হস্তক্ষেপ করতে পারেন।’
তবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টে অপ্রীতিকর এসব ঘটনায় আইনজীবীদের মধ্যে থেকেই সংকট সমাধানে বিবদমান দুই পক্ষেই উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি আইনজীবীদের মধ্যে পারস্পারিক সম্মান, শ্রদ্ধা ও দায়িত্বশীলতাও বাড়াতে হবে।’
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদগার, বিক্ষোভ, পাল্টা বিক্ষোভ, ভাঙচুর করা একেবারেই কাম্য নয়। সাম্প্রতিক সময়ের হওয়া এসব কর্মকাণ্ড আইনজীবীদের পেশার জন্যও ভালো নয় এবং তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।’
এসব সমস্যা সমাধানের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন সুপ্রিম কোর্টে বিক্ষোভ, সমাবেশ, মানববন্ধন, ভাঙচুর, আইনজীবীদের আহত করা এসব করা হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি পেশাদার সংগঠন। এখানে একে অন্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, ধাক্কাধাক্কি, ভাঙচুর করা একেবারেই কাম্য নয়। আইনজীবীদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়া আলোচনার মাধ্যমে ফয়সালা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের নিয়ে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’
সারাবাংলা/কেআইএফ/এমও