সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে যেভাবে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত—
৩ জুলাই ২০২৩ ১০:২২
ঢাকা: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি (সুপ্রিম কোর্ট বার) দেশের অত্যন্ত মর্যাদাশীল একটি পেশাদার সংগঠন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, প্রকাশ পাকরাশি, সৈয়দ মোদারেস আলী এবং সবিতা রঞ্জন পালের (এস আর পাল) মতো বরেণ্য আইনজীবীদের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট বার প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে আরও অনেক বিখ্যাত আইনজ্ঞরা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট বারকে পেশাদারিত্ব ও মর্যাদায় নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির গত নির্বাচনকে (২০২৩-২০২৪ মেয়াদে) কেন্দ্র করে দু’পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হাতিহাতি, মারামারি, ভাঙচুর, মামলা, গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা দেশের গণ্ডী পেরিয়ে বহু বিদেশি গণমাধ্যমেও সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। ওই নির্বাচনের পর থেকে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে আইনজীবীদের বিবদমান সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ, মিছিল, মানববন্ধন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিভিন্ন দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা মিছিল, সমাবেশ, শোডাউন করে; দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে দ্বন্দ্ব, সংঘাতে যেমন জড়ায়; সুপ্রিম কোর্ট বারেও এখন একই ধরনের চিত্র চোখে পড়ে। যেখানে দু’পক্ষের আইনজীবীদের মহড়া চলে। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে বারের মর্যাদা। হ্রাস পাচ্ছে আইনজীবীদের সম্মান। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বারের পেশাদার আইনজীবীরাই।
অন্যদিকে, এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের বাইরেও তৈরি হয়েছে মোর্চা, ফ্রন্ট নামে একাধিক সংগঠন। আর নানা বলয়, বিভাজন ও অপ্রীতিকর আচরণের কারণে আইনজীবীদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসে যেমন চিড় ধরছে; তেমনি তৈরি হচ্ছে নেতিবাচক মনোভাব।
কেন, কীভাবে এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? হামলা, ভাঙচুর, মামলা কি শুধু নির্বাচন নিয়েই? সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে সমিতির গঠনতন্ত্রের ১৫ নং ধারায় বার নির্বাচনের প্রসঙ্গটি উল্লেখ আছে।
‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের গঠনতন্ত্র ও বিধিমালা’ এর ১৫ এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে, সম্পাদকের কাছে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ব্যালট পেপার থাকবে, যার মধ্যে সব প্রার্থীর নাম মুদ্রিত হবে এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক ব্যালট বাক্স তৈরি করা হবে এবং নির্বাচনের জন্য তা ব্যবহার করা হবে।
গঠনতন্ত্রের ১৫ এর ৬ ধারায় বলা হয়েছে, কার্যনির্বাহী কমিটি নির্বাচনের জন্য একটি উপ-কমিটি গঠন করবে যেটিতে ৭ জনের বেশি নিয়মিত সদস্য নির্বাচন করবেন না, যার মধ্যে একজন সমিতির সিনিয়র নিয়মিত সদস্য হবেন, তিনি উপ-কমিটির কমিটির আহ্বায়ক হিসাবে কাজ করবেন। উপ-কমিটির ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানে ভোট পরিচালনা করা হবে এবং সম্পাদক এটিকে সুষ্ঠু ও দক্ষতার সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সহায়তা প্রদান করবেন।
এখানেই সমিতির সম্পাদকের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা উপ-কমিটির মতভেদ তৈরি হয়। সমিতির সম্পাদক (আব্দুন নূর দুলাল) বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী আমি ভোটের ব্যালট পেপার সরবরাহ করব। আর মুনসুরুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন উপ-কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় মেশিনের সাহায্যে ভোট গণনা করা হবে।’
নির্বাচন উপ-কমিটির সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পাদকসহ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের ঐক্যমত্য না হওয়ার এক পর্যায়ে উপকমিটি হতে এর প্রধান মুনসুরুল হক চৌধুরী পদত্যাগ করেন।
বারে আইনজীবীদের দ্বন্দ্বের সমাধান কোন পথে?
এরপর জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ভোট বয়কট করে। অন্যদিকে, ভোট আয়োজনে অনড় থাকে সরকার সমর্থক বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের আইনজীবীরা। এরপর সরকার সমর্থক আইনজীবীদের নিয়ে গঠিত নতুন উপ-কমিটির অধীন অনুষ্ঠিত ভোটে ব্যাপক ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ পূর্ণ প্যানেলে জয়লাভ করে।
এরপর থেকে সুপ্রিম কোর্ট বারে বিশৃঙ্খলা, হামলা, ভাঙচুর, মারামারি, হাতাহাতি, বিক্ষোভ, মিছিল-মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন অব্যাহত রয়েছে। এরইমধ্যে নতুন মোর্চা, নতুন গ্রুপ তৈরি হয়েছে। এর ফলে সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের মাঝে বেড়েছে দ্বন্দ্ব ও বিভাজন। প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে নানা দল, উপদলের।
এরপর চলতি মাসে এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্ট বারে ফ্রন্ট, মোর্চা নামে কয়েকটি সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছে। এসব সংগঠনের তৎপরতা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে গত ৭ জুন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সামনে ‘সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক কর্ম পরিবেশের’ দাবিতে মানববন্ধন করেছে ‘আইনজীবী কংগ্রেস’ নামের একটি সংগঠন।
মানববন্ধন থেকে বিবাদমান পক্ষগুলোকে সহনশীল ও মার্জিত আচরণের আহবান জানানো হয়। পাশাপাশি আইনজীবীদের সুনাম ও নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হয় এমন কর্মকান্ড পরিহারের অনুরোধ করা হয়।
এরপর গত ১৮ জুন বাংলাদেশ নিউট্রাল লইয়ার্স ফ্রন্ট (বিএনএলএফ) নামের একটি সংগঠন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির গঠনতন্ত্রের ১৫ (৬) ধারা সংশোধনের দাবি জানায়। সংগঠনের আহ্বায়ক এ বি এম ওয়ালিউর রহমান খান বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির গঠনতন্ত্রের ১৫ (৬) ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করছি। ওই ধারায় নির্বাচন সাব কমিটির পরিবর্তে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব রাখছি। গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশন গঠন হলে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঘৃণ্যতম কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি হবে না।’
গত ১৪-১৫ মার্চে অনুষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (২০২২-২৩) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আদালত আঙ্গিনায় প্রায় প্রতিদিনই যে ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। যা আইনজীবীদের জন্য কাম্য নয়। প্রায়ই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, মিছিল, হাতাহাতি এমনকি বার্ষিক ইফতার থেকেও আইনজীবীরা বঞ্চিত হয়েছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ ও মুক্তির লক্ষে সাধারণ আইনজীবীরা গত ২৯ মে নিউট্রাল লইয়ার্স ফ্রন্ট (Neutrul lawyer’s front) গঠন করে বলে জানান আইনজীবী ওয়ালিউর রহমান খান।
এর আগে গত ১২ জুন ইউনাইটেড লইয়ার্স ফ্রন্ট (ইউএলএফ) নামের একটি সংগঠন এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের আহ্বায়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘২০২২-২০২৩ মেয়াদে সুপ্রিম কোর্ট বারের ভোট গণনার সময়, গণনা শেষ না হতেই বিশেষ একজন সম্পাদক প্রার্থী বারের বাইরের শক্তির ক্ষমতা ও দন্ধে অসাংবিধানিকভাবে পুনর্গণনার দাবি জানায়। ফলশ্রুতিতে অনানুষ্ঠানিক ফলাফল আমাদের জানা সত্ত্বেও আনুষ্ঠানিকভাবে কোন ফলাফল ঘোষণা করতে দেয়নি। পরবর্তীতে পুলিশের সহযোগিতায় বৈধভাবে নির্বাচিত সম্পাদককে হটিয়ে সম্পাদকের অফিস দখল করেন জনৈক দখলদার। এমনকি গত বছর ওই দখলদার চক্র সংবিধানের ১৫(৮) অনুযায়ী সাধারণ সভার মাধ্যমে দায়িত্বভারও গ্রহণ করেনি। দুর্ভাগ্যের বিষয় বারের গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলো এবং আইনজীবী নেতৃত্ব এবং বারের মালিক অর্থাৎ সকল সদস্য এক গভীর নিরবতা পালন করে। কর্তৃত্ববাদী শক্তির কাছে আজ্ঞাবহ বার হিসেবে পরিগণিত করার লক্ষ্যেই গত ১৫ ও ১৬ মার্চ বারের কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেয়নি তারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির অনুমতি ছাড়া বারে পুলিশ ডেকে এনে অডিটোরিয়ামে স্থাপিত নির্বাচনী বুথগুলোতে পুলিশ নির্লজ্জভাবে আইনজীবী এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায় এবং সরকার সমর্থক আইনজীবী প্রার্থী ব্যতিত অন্য সব প্রার্থীদের মারধর করে এবং বুথ থেকে জোরপূর্বক বের করে দেয়। সহজ কথায়, যুগে যুগে স্বৈরাচাররা নির্বাচনের নামে যে প্রহসন করেছে, গত ১৫, ১৬ মার্চ নির্বাচনেও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে।’
আইনজীবীদের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধা, সৌহার্দ এবং স্বাধীন বিচার বিভাগের অস্তিত্ব অক্ষুণ্ন রাখার লক্ষ্যে মতের ভিন্নতা থাকলেও আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং স্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট বারসহ সমস্ত বারসমূহকে স্বাধীন রাখার জন্য আইনজীবীদের নির্দলীয় প্ল্যার্টফর্ম প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যেই ইউনাইটেড লইয়ার্স ফ্রন্ট (United Lawyers Front) গঠিত হয়েছে বলে জানান আইনজীবী জয়নুল আবেদীন।
এরপর গত ১৪ জুন সমিতির মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটি। সংবাদ সম্মেলনে বারের সম্পাদক আব্দুন নূর দুলাল ‘ইউনাইটেড লইয়ার্স ফ্রন্টে’র বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেন।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ইউনাইটেড লইয়ার্স ফ্রন্টের এবং তাদের লিখিত বক্তব্য ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে দুলাল বলেন, ‘ইউনাইটেড লইয়ার্স ফ্রন্ট নামীয় কথিত জোট বিএনপি এবং জামায়াতের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের একটি অপভ্রংশ মাত্র। এটি নতুন করে সন্ত্রাস সৃষ্টির একটি অপপ্রয়াস।’
সারাবাংলা/কেআইএফ/এমও